দুর্যোগ

বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে করণীয়

এ বছর বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ কোনো কোনো এলাকায় স্বাভাবিক বন্যা হলেও, ২০ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ফেনীসহ ১১ জেলায় সংঘটিত বন্যা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। যার কারণ হিসেবে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সীমান্তে ভারত কর্তৃক হঠাৎ বাঁধ খুলে দেওয়াকে দায়ী করা হয়। যদিও ভারত এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ফলে বিষয়টি এখনও বিতর্কিতই রয়ে গেছে। যদি ধরেও নিই, পূর্ব ঘোষণা ছাড়া বাঁধ খুলে দেওয়াই এ বন্যার কারণ– তবুও স্বীকার করতে হবে, আমাদের বন্যাপ্রবণ এলাকার অভ্যন্তরীণ বাঁধগুলো যথাযথ মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ না করা অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও জবাবদিহির অভাবে প্রবল পানির তোড়ে গোমতী বাঁধসহ অনেক ছোট-বড় বাঁধ ভেঙে গিয়ে এ বন্যাকে বিস্তৃত ও ভয়াবহ করেছে। যার ফলে ১১ জেলায় অক্সফ্যামের তথ্য অনুসারে (সমকাল ৪ সেপ্টেম্বর) ৫৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বন্যায় ১১ জেলায় ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে এবারের বন্যায় মৃতের সংখ্যা ১০১ (সমকাল ৭ সেপ্টেম্বর), যদিও এর মধ্যে ১১ জেলায় মৃতের সংখ্যা কত, তা বলা হয়নি। 

আগস্টের বন্যার কঠিন সময়টা সরকারি-বেসরকারি, এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে উত্তরণ করা গেছে। সম্মিলিত মানবিক কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ কমাতে সবাই ছিল তৎপর। তবে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দুর্যোগাক্রান্ত দুর্গম এলাকায় সাহায্য সময়মতো পৌঁছে না অথবা তা হয় অপর্যাপ্ত। কারণ অনেক সংস্থারই ফোকাস থাকে যেখানে সহজে পৌঁছানো যায় এমন এলাকা।

বলতে দ্বিধা নেই, অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়া বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সহজে নজর কাড়ে এমন জায়গা বেছে নেয় অনেক সংস্থা। আমার কর্মজীবনে বিভিন্ন দুর্যোগ ও সংকটে রংপুরের গঙ্গাচড়া, কুড়িগ্রামের চিলমারী, গাইবান্ধার সাঘাটাসহ অনেক এলাকার দুর্গম চরে অথবা পার্বত্য জেলাগুলোর প্রত্যন্ত জনপদে ত্রাণসহ অন্যান্য মানবিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণকালে এমন চিত্র দেখেছি অনেক সময়। কিন্তু সরকারসহ সব মানবিক সংস্থাকে ‘দুর্যোগে কেউ পিছিয়ে নেই’ নীতি অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ দুর্যোগে যে (নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, অন্যান্য) যেখানেই অবস্থান করুক, কাউকে সেবা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। 

যে কোনো বন্যা মানেই ক্ষয়ক্ষতি। সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষতি ছিল ব্যাপক। খাদ্য সংকটের সঙ্গে অধিকাংশ বাড়িঘর সম্পূর্ণ অথবা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। তাই এসব এলাকার মানুষের খাদ্য নিশ্চয়তার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে বাড়িঘর মেরামতকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। বন্যায় পানির প্রধান উৎস অর্থাৎ টিউবওয়েল নষ্ট অথবা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। ফলে বন্যাক্রান্ত এলাকায়  বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। এসব এলাকায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, যা কাটিয়ে উঠতে হবে।

সম্প্রতি ব্র্যাক আয়োজিত এক সেমিনারে বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবস্থাসহ সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্যায় অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে এবং মাছ চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলো এখনই মেরামতের উদ্যোগ না নিলে পুনরায় বন্যা হলে মানুষ আবার দুর্দশায় পড়বে।
মনে আছে, ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে গোমতী বাঁধ ভেঙে কুমিল্লার প্রায় সব উপজেলার গ্রাম-গ্রামান্তর এমনকি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা ও দেবিদ্বারের কিছু অংশ ডুবে যায়। আমি সেখানে রেড ক্রসের পক্ষে বন্যার ত্রাণ পরিচালনার জন্য যাই। কিন্তু ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের কোনো উদ্যোগ দেখি না। ফলে প্রথমবার বাঁধ ভাঙার মাসখানেক পর প্রবল বৃষ্টির কারণে আবারও বাঁধ-সংলগ্ন এলাকার মানুষ দ্বিতীয়বারের মতো বন্যায় আক্রান্ত হয়। তাই পরামর্শ, শুষ্ক মৌসুমের অপেক্ষায় না থেকে এখনই ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপশি বিদ্যমান ছোট-বড় বাঁধে নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে সারাবছর, বিশেষত বর্ষা মৌসুমের আগে। 

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মানবিক সংস্থাগুলো যার যার মতো এলাকা নির্ধারণ করে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুসারে কার্যক্রম বাস্তবায়নে আগ্রহী। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাহায্য ক্ষতিগ্রস্তদের সাময়িক চাহিদা মেটালেও স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া প্রতিটি সংস্থাই যার যার দাতার অগ্রাধিকার বিবেচনায় বিচ্ছিন্নভাবে চাহিদা নিরূপণ করে থাকে, যা সময় ও অর্থের অপচয় ঘটায়। অথচ সমন্বিত পরিকল্পনা নিশ্চিত করে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে একদিকে যেমন সময় ও অর্থের সাশ্রয় হয়, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও কমিউনিটির জন্য দীর্ঘমেয়াদি

ফল নিশ্চিত করা যায়, যা তাদের ভবিষ্যৎ দুর্যোগে বিপদ প্রশমন করতে পারে। 


দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আগ্রহ ও উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দুর্যোগে সাড়া প্রদানবিষয়ক বিভিন্ন অঙ্গীকার প্রতিপালনে আগ্রহ থাকে না।

এ ধরনের অঙ্গীকারের মধ্যে রেড ক্রস, অক্সফ্যাম, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ ৮টি আন্তর্জাতিক সংস্থা সূচনাকৃত মানবিক সহায়তা বিতরণে ১০টি আচরণবিধির অঙ্গীকার করেছে। এতে এ পর্যন্ত ৯ শতাধিক মানবিক সংস্থা স্বাক্ষর করেছে। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো দুর্গতদের মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা; অসহায় বা দয়ার পাত্র হিসেবে নয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতিসংঘ সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্কের ঘোষণা (২০১৫) আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
অর্থাৎ পুনরুদ্ধারের আওতায় আমাদের উদ্যোগ হতে হবে দুর্গতদের শুধুই তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া নয়, বরং আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় নিয়ে যাওয়া, যা দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রশমন সম্পর্কে অধিক ধারণা প্রদান এবং ব্যক্তি ও কমিউনিটির সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্জন সম্ভব। এ ছাড়া পুনরুদ্ধার কাজে ইনক্লুসিভনেস নীতি অর্থাৎ অধিক বিপদাপন্ন (নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি) জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। 

আগস্টের বন্যা মোকাবিলায় ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে সবার উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও আমাদের মানবিক অঙ্গীকারগুলো প্রতিপালন করতে হবে। সমকালীন দুর্যোগ দৃশ্যপট বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা এখন আর শুধু অনুগ্রহের পাত্র নয়। তাদের মর্যাদা, মতামত, চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে এবং আমাদের উদ্যোগে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ফল নিশ্চিত করাই হবে সব মানবিক কার্যক্রমের প্রেরণা।

এম. এ. হালিম: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
halim_64@hotmail.com 



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews