আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের সংবিধান থেকে ধর্মরিপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ওই দুটি দাবি এসেছিল মুক্তির জাগ্রত আকাঙ্ক্ষা থেকেই। পাকিস্তান আমলে তৈরি সাম্প্রদায়িক ও শ্রেণিগত বিভাজনকে নাকচ করে দিতে চেয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মূলনীতি দুটি যে বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল সেটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, স্বাভাবিক ঘটনা বটে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, আমাদের ইতিহাসের একমাত্র জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধে জনতার জয় হয়েছিল। কিন্তু বিজয়ী জনতা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, ক্ষমতা আগের মতোই চলে যাচ্ছিল অল্প কিছু মানুষের হাতে। পঁচাত্তরের নৃশংস পটপরিবর্তনের পর নতুন যারা ক্ষমতায় এলো তারা শুধু ক্ষমতাই বুঝেছে, অন্যকিছু বুঝতে চায়নি। তারা জনগণের লোক নয়, জনগণের আদর্শ তাদের নয়। তাদের আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থান ছিল না। তারা তাদের আদর্শকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তারপর ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচয় দিলেও মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাকে ধারণ করেছেন, সেটা বলা যাবে না। সংগত কারণে তারাও সরিয়ে-দেওয়া মূলনীতি দুটি ফেরত আনতে পারেনি নিজেদের সীমাবদ্ধতার কারণে। ফেরত আনা পরের কথা, তারা সাংবিধানিক বৈধতাও দিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে। এই উদাসীনতা তাৎপর্যহীন নয়। বাস্তবতা বদলে গেছে। জনগণ যে স্বপ্ন দেখেছিল তা এখন অতীতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হয়তো-বা অতীতের স্মৃতিতেই পরিণত হবে, কারও কারও হয়তো মনে এমন আশা রয়েছে। লোক দেখানোভাবে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হলেও তা শুধু নামকাওয়াস্তে।
মূল সত্যটা হচ্ছে এই যে, জনগণের কাছে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা থেকে তারা অনেক দূরে। সামরিক সরকারের আমলে দূরে ছিল, নির্বাচিত সরকারের আমলেও সেই দূরেই রয়ে গেছে। বর্তমান আমলেও তদ্রুপ। এই দূরত্ব আগামীতে বাড়বে না, বরঞ্চ কমে আসবে, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? তা তো বলা যাবে না। জনগণের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটাবার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি কই? কর্মসংস্থানের উদ্যোগ কোথায়?রাষ্ট্রক্ষমতায় যে বড় পরিবর্তন এসেছে সেগুলো এমনি এমনি ঘটেনি, বিত্তবানদের কারণেও ঘটেনি। প্রত্যেকটির পেছনেই জনগণ ছিল। ১৯৪৬-এ সাধারণ মানুষ ভোট দিয়েছে। ১৯৭১-এ সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাতেই রাষ্ট্র বদলেছে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ; ওই স্বাধীনতায় মুক্তি এলো না। উল্টো মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ল। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ভিন্ন প্রকারের, তার সামনে মুক্তির লক্ষ্যটা ছিল আরও স্পষ্ট, আরও প্রত্যক্ষ। কিন্তু এই স্বাধীনতা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে কি? মুক্তি এসেছে কি মানুষের? সে তো মনে হয় অনেক দূরের ব্যাপার।
মুক্তি না-আসার কারণটি হচ্ছে এই যে, সংগ্রাম জনগণই করেছে এটা ঠিক, কিন্তু নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিল না। জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ কী? জনগণ তো ব্যক্তি নয়, এক নয়, তারা বহু, অসংখ্য, কে নেতা হবে কাকে ফেলে? জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ হলো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন সংগঠনের হাতে নেতৃত্ব থাকা। স্বার্থটাই আসল কথা। আওয়াজ উঠতে পারে নানাবিধ, আওয়াজ মানুষকে উদ্বুদ্ধও করে নানাভাবে, কিন্তু ধ্বনি যথেষ্ট নয়, কার স্বার্থে ধ্বনি উঠেছে সেটাই জরুরি।
স্বাধীনতার পরে প্রত্যাশিত ছিল যে, সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকরা ঐক্যবদ্ধ হবে। তারা তা হয়নি। বরঞ্চ বিভাজন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংগঠিত করবে। কিন্তু পুঁজিবাদের সর্বাত্মক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বুর্জোয়া পাওয়া যায়নি, লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়ারাই কর্তৃত্ব করেছে। এরা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাই বিশ্ব পুঁজিবাদের আগ্রাসনের মুখে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করতেও তারা প্রস্তুত থেকেছে। লুণ্ঠনকারীরা সেটাই করে; মুফতে-পাওয়া সম্পত্তির প্রতি তাদের কোনো মায়া, মমতা থাকে না। বাম উগ্রপন্থিদের কেউ কেউ আবার বলতে চেয়েছে যে, স্বাধীনতা আসেনি, রুশ-ভারত অক্ষশক্তি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে মাত্র। এসব বিচ্ছেদ ও বিভ্রান্তির কারণে জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে এমন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হতে পারেনি।
একাত্তরের পরে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়েছিল তাদের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল। তাদের দলীয় তরুণদের একাংশ দেখছিল তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পারছে না, অপরাংশের তুলনায় তারা সুবিচার পাচ্ছে না। হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে তারা বের হয়ে এসে নতুন সংগঠন গড়েছে, নাম দিয়েছে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তাদেরও যেহেতু শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন ছিল এবং এই শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার কাছ থেকে পাবে বলে আশা করা যাচ্ছিল না, তাই তারা জনগণের কাছে গেল। জানতো তারা যে জনগণ পুরাতন আওয়াজে আর সাড়া দেবে না। তাই নতুন রণধ্বনি তুলল সমাজতন্ত্রের এবং হাজার হাজার তরুণ, যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছিল, যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কিন্তু মুক্তির পথ দেখতে পায়নি তারা তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়েছে, যোগ দিয়েছে ওই দলে। ওই দলের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ এখনো সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগুতে চাইছে, কিন্তু মূল দলসহ বাদবাকিরা ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও মাত্রায় বিলীন হয়ে গেছে।
আল-বদর, রাজাকাররা ফিরে এসেছে, অধিক শক্তিমত্তায়। মৌলবাদ শক্তিশালী হয়েছে। এর মূল কারণ ওই একটাই, চব্বিশের রেজিম পরিবর্তনে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি। সমাজ একটা ধাক্কা খেয়েছে, সে নড়ে উঠেছে, কিন্তু এমনভাবে আধুনিক হয়নি যে রাজাকার ও মৌলবাদ অতীতের প্রাণী বলে চিহ্নিত হবে, পরিণত হবে এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতে। ক্ষমতায় যারা যাতায়াত করে রাজকার ও মৌলবাদ তাদের কাছে যথার্থ অর্থে দূরের নয়। কারও জন্য খুব কাছের, কারও জন্য ততটা কাছের নয়, ব্যবধান এটুকুই, সেটা মাত্রাগত, গুণগত নয়। সমাজে বৈপ্লবিক রূপান্তরের চেষ্টা যদি চলতো তাহলে এরা প্রশ্রয় পেত না। শাসকশ্রেণি ধর্মকে ব্যবহার করে চলেছে, দুই কারণে। এক. জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়িত্বের অভিপ্রায়ে। দুই. নিজেরাই যেসব অন্যায় করছে তার দরুন তৈরি অপরাধবোধ থেকে অব্যাহতি পাবার ভরসায়।
বাংলাদেশের জন্য গ্রামই ছিল ভরসা। আন্দোলনে গ্রাম না এলে জয় আসেনি। বিপদের সময় গ্রাম যদি আশ্রয় না দিত তবে বিপদ ভয়াবহ হতো। গ্রামেই রয়েছে উৎপাদক শক্তি। গ্রামবাসীর শ্রমে তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য লুণ্ঠন করেই ধনীরা ধনী হয়েছে। এখনো গ্রাম কাজে লাগছে বিদেশ থেকে সাহায্য, ঋণ, দান ইত্যাদি এনে তার সিংহ ভাগ আত্মসাৎ করার অজুহাত ও অবলম্বন হিসেবে। একাত্তরে আমারা গ্রামে গেছি। বাড়িঘর, মজা পুকুর, হারিয়ে-যাওয়া খেত, মৃতপ্রায় গাছপালা-এসবের খোঁজখবর করেছি। শহর তখন চলে গেছে শত্রুর কবলে, যাকগে, আমরা গ্রামেই থাকব- এই সিদ্ধান্ত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। শহরের পতন ঘটেছে সর্বাগ্রে, গ্রামের ঘটেনি, যদি ঘটত তাহলে আমাদের পক্ষে অত দ্রুত বিজয় সম্ভব হতো না।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র গ্রামে যারা গিয়েছিল তারা যত দ্রুতগতিতে গেছে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে ফেরত চলে এসেছে। পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর, কারখানা, অফিস, পদ, গাড়ি যে যেটা পেরেছে লুণ্ঠন করেছে। পাকিস্তানিরা অব্যাহতভাবে লুণ্ঠন করেছিল ২৪ বছর, বিশেষ করে নয় মাসে তাদের তৎপরতা সীমাহীন হয়ে পড়েছিল, তারা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল সব কিছু। স্বাধীনতার পরে সুবিধাভোগীরা শোধ নিয়েছে। লুটপাট করেছে স্বাধীনভাবে। এখনো করছে।
গ্রাম রইল সেখানেই যেখানে ছিল। বস্তুত খারাপই হলো তার অবস্থা। পাকিস্তানিরা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সব করেছে। ঘর পুড়িয়েছে, ফসল জ্বালিয়েছে। স্বাধীনতার পরে গ্রামবাসী পুরাতন জীবন ফিরে পায়নি। অবকাঠামো গিয়েছিল ভেঙে। বন্যা এলো। এলো দুর্ভিক্ষ। বিপুলসংখ্যক মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ল। গ্রাম এখন ধেয়ে আসছে শহরের দিকে। আশ্রয়দাতা হিসেবে নয়, আসছে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। তার হাত দুটি মুক্তিযোদ্ধার নয়, হাত তার ভিখারির। ফলে শহর এখন বিপন্ন মনে করছে নিজেকে। ভাবছে আবার তার পতন ঘটবে-এবার পাকিস্তানিদের হাতে নয়, গরিব বাংলাদেশিদের হাতে। মনে হচ্ছে আবারও একটা মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হবে। না, তেমন যুদ্ধ ঘটবে না। কেননা মুক্তিযুদ্ধ তো চলছেই কোনো না কোনোভাবে। মানুষ যে মুক্ত হয়নি সেটা কারও কাছেই অস্পষ্ট নয়। ওই যুদ্ধকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা শাসকশ্রেণির দল করবে না। তার জন্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন হবে। ডানদিকের নয়, বামদিকের।
বলা হয়, গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে সংখ্যাগুরুর শাসন। কিন্তু আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা, অর্থাৎ ধনীরা শাসন করে সংখ্যাগুরুকে, অর্থাৎ গরিবকে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ব্যবস্থা চলা উচিত নয়। এটা চলবেও না। এই জন্য যে সংখ্যাগুরু সচেতন ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে। তারা মুক্তি চায়। পরিবর্তন একটা ঘটবেই। প্রশ্ন হলো, কবে এবং কিভাবে। স্বাধীনতা ওই বড় পরিবর্তনের জন্যই প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নিজেই দুর্বল হয়ে পড়বে যদি জাতীয় মুক্তি না আসে। মুক্তির প্রশ্নটি এখন আর আঞ্চলিক নয়। দ্বন্দ্ব এখন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের নয়, প্রশ্নটি এখন শ্রেণিগত, দ্বন্দ্ব এখন বাঙালি ধনীর সঙ্গে বাঙালি গরিবের। বিষয়টা এমন পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পেত না বাংলাদেশ যদি স্বাধীন না হতো। স্বাধীনতা আমাদের খুবই জরুরি ছিল, সমষ্টিগত অগ্রগতির পথে প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়