প্রশ্ন: আমার বয়স ২৫ বছর। তিন মাসের প্রেগন্যান্ট আমি। আমার ছোটবেলাটা খুব কষ্টে কেটেছে। আমার সৎ মা আমাকে খাওয়ার কষ্ট দিত। আমার বাবা দেখেও দেখতো না। আমি নিজে ইনকাম শুরুর পর শুধু রেস্তোরাঁয় গিয়ে গিয়ে ভালো ভালো খাবার খেতাম আর কাঁদতাম। এখন খাওয়ার কষ্ট নেই। কিন্তু ঘুমের মধ্যে সেই কষ্টের দিনগুলো স্বপ্ন দেখছি শুধু। প্রতিদিন এগুলো স্বপ্ন দেখি আর আতংক লাগে যে আমার বাচ্চার ভবিষ্যতও আবার এমন হবে না তো? দিন দিন মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি।
উত্তর: আপনার বর্তমান মানসিক যন্ত্রণা এবং অতীতের ট্রমা খুবই বোঝার মতো, বিশেষ করে যখন আপনি গর্ভবতী এবং আপনার শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন এবং আগের unresolved trauma (অমীমাংসিত আঘাত) মিলে আপনার স্বপ্ন ও উদ্বেগকে তীব্র করে তুলতে পারে। তবে কিছু পদক্ষেপ নিলে আপনি ধীরে ধীরে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন-
১. পেশাদার সাহায্য নিন: একজন সাইকোলজিস্ট/ সাইকিয়াট্রিস্ট-এর সঙ্গে কথা বলুন, যিনি Trauma Therapy (ট্রমা থেরাপি) বা CBT (Cognitive Behavioral Therapy) দিতে পারেন। তারা আপনাকে অতীতের দুঃখজনক স্মৃতিগুলো প্রসেস করতে এবং বর্তমানের উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করবেন। গর্ভাবস্থায় ডিপ্রেশন/ অ্যাংজাইটি হতে পারে, যা আপনার ও শিশুর স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা নিলে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
২. সেলফ-কম্পাশন (নিজেকে ভালোবাসা): আপনি আপনার ছোটবেলার সেই অসহায় বাচ্চাটিকে আজ রক্ষা করতে পারবেন না, কিন্তু এখন নিজেকে বলুন: ‘আমি তখন একা ছিলাম, কিন্তু এখন আমি শক্তিশালী। আমার শিশুকে আমি সেই কষ্ট দেব না।’ প্রতিদিন কিছু সময় নিজেকে positive affirmations দিন: ‘আমি একজন ভালো মা হবো, আমার অতীত আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না।’
৩. সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করুন: আপনার পার্টনার, বন্ধু বা আত্মীয় যারা আপনাকে বুঝবে, তাদের সঙ্গে আপনার ভয় ও আশঙ্কাগুলো শেয়ার করুন। একা বোধ করলে সাপোর্ট গ্রুপ (যেমন: অনলাইনে মাতৃত্ব বিষয়ক ফোরাম) যোগ দিতে পারেন।
৪. রুটিন তৈরি করুন: গর্ভাবস্থায় অ্যাংজাইটি বাড়লে একটি রুটিন মেনটাল হেলথ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। যেমন: প্রতিদিন হালকা হাঁটা বা প্রেগন্যান্সি-ফ্রেন্ডলি ইয়োগা। রাতে ঘুমানোর আগে গরম দুধ, মেডিটেশন বা সফট মিউজিক শোনা। স্বপ্নের কারণে ভয় পেলে জেগে উঠলে সাথে সাথে ডিপ ব্রিদিং (গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস) চর্চা করুন।
৫. আপনার শিশুর জন্য ইতিবাচক পরিকল্পনা: আপনার অতীতের অভিজ্ঞতা আপনাকে একজন সচেতন মা হতে সাহায্য করবে। লিখে ফেলুন—আপনার শিশুকে কী কী দিতে চান (ভালোবাসা, নিরাপত্তা, শিক্ষা), যাতে তার জীবন আপনার থেকে আলাদা হয়। শিশুর জন্মের পরও যদি ট্রমার লক্ষণ (মুড সুইং, ফ্ল্যাশব্যাক) থাকে, তাহলে পোস্টপার্টাম থেরাপি নিন।
৬. জরুরি অবস্থায়: যদি আত্মহত্যার বা নিজের/শিশুর ক্ষতি করার মতো চিন্তা আসে, অবিলম্বে নিকটস্থ মানসিক হাসপাতালের বা সরকারি হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন। আপনি ইতোমধ্যে অনেক লড়াই করে নিজের জীবন বদলেছেন-এটা আপনার সাহসিকতা প্রমাণ করে। এখন শুধু নিজেকে একটু বেশি যত্ন নেওয়ার সময়। আপনার শিশু একজন সুখী মায়ের সঙ্গ পাবে, এটাই সবচেয়ে বড় উপহার।
প্রশ্ন: আমার বয়স ৩২ বছর। কোনও কারণ ছাড়াই আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না, হতাশ লাগে। কোনও কিছুতেই এই হতাশা কাটে না। অথচ এটার কোনও সুস্পস্ট কারণ নেই। বেঁচে থাকাকে ক্লান্তিকর লাগে আমার।
উত্তর: আপনার এই অনুভূতিগুলো অত্যন্ত বাস্তব এবং গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার মতো– বিশেষ করে যখন কোনও ‘সুস্পষ্ট কারণ’ ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে জীবন ক্লান্তিকর ও অর্থহীন লাগে। এই ধরনের অবসাদ (Depression) কখনো শারীরিক বা রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতার কারণেও হতে পারে, যা পেশাদার সাহায্য ছাড়া কাটানো কঠিন। কিছু জরুরি পদক্ষেপ-
১. অবিলম্বে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিন: মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের (সেরোটোনিন, ডোপামিন ইত্যাদি) ভারসাম্যহীনতা বা শারীরিক সমস্যা (থাইরয়েড, ভিটামিন ডি ঘাটতি) ডিপ্রেশন ট্রিগার করতে পারে। ওষুধ (Antidepressants) বা থেরাপি জীবন বদলে দিতে পারে।
২. সাইকোথেরাপি: CBT (Cognitive Behavioral Therapy) বা ACT (Acceptance and Commitment Therapy) অব্যক্ত হতাশার মূল কারণ খুঁজে তুলে ধরতে সাহায্য করে।
৩. এই অবস্থার প্রকৃতি বোঝা: ‘কোনও কারণ ছাড়া ডিপ্রেশ’ একটি বৈজ্ঞানিক সত্য– এটি মনের ‘ডায়াবেটিস’ বা ‘প্রেশারের’ মতোই একটি শারীরবৃত্তীয় অবস্থা। দেখুন তো লক্ষণগুলো মেলে নাকি?
দৈনন্দিন কাজে আগ্রহ হারানো
ঘুম/ক্ষুধার পরিবর্তন
শক্তিহীনতা, মনোযোগের অভাব
নিজেকে দোষারোপ করা বা বোঝা মনে হওয়া
৪. আত্মহত্যার চিন্তা আসলে কী করবেন: ‘বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না’– এই কথাটি সুইসাইডাল থটের (আত্মহত্যা-সংক্রান্ত চিন্তা) ইঙ্গিত দেয়। তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ-
জরুরি হেল্পলাইনে কল করুন: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা: ০৯৬১১৬৭৭৭৭৭
কাছের হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমে যান
বিশ্বস্ত কাউকে (আত্মীয়/বন্ধু) বলুন, ‘আমার এখন সাহায্য দরকার’
৫. নিজের জন্য ছোট ছোট ব্যবস্থ: ডিপ্রেশন শারীরিক শক্তি কেড়ে নেয়। রক্ত পরীক্ষা করান, হাঁটুন, সূর্যের আলো গায়ে লাগান (ভিটামিন ডি)। সামাজিক সংযোগ বাড়ান। একা থাকবেন না। এমন কাউকে খুঁজুন যিনি শুধু শুনবেন– সমাধান দেবেন না। রুটিন তৈরি করুন। ঘুম, খাওয়া, হালকা ব্যায়াম – ছোট ছোট জিনিসে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।
৬. এই ভাবনা থেকে মুক্তির পথ: ‘জীবন ক্লান্তিকর’– এই বোধ অস্থায়ী, ডিপ্রেশনের কারণে আপনার মনে এমন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। আপনি একা নন, বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষ এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। চিকিৎসা নিলে ৮০-৯০% ডিপ্রেশন সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ হয়। আপনার অনুভূতিকে ‘অযৌক্তিক’ বলে দাবাবেন না– এগুলো আপনার লড়াইয়ের প্রমাণ।