পুরান ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী চাঁদ মিয়া ওরফে সোহাগকে হত্যার পর লাশ ঘিরে সন্ত্রাসীদের নৃশংস আচরণের যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেটি দেখে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ হতবাক হয়ে পড়েছে। তারা শুধু আতঙ্কিতই নয়, চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। শুধু চাঁদা না পাওয়ার ক্ষোভে সন্ত্রাসীরা সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যা করেই খ্যান্ত হয়নি, পৈশাচিকভাবে মৃত্যু নিশ্চিতে লাশের ওপর একের পর এক পাথর নিক্ষেপ করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেক প্রশ্নের উত্তর খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই। কারণ সোহাগকে গত বুধবার সন্ধ্যায় হত্যার আগের দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার রাত আটটায় তার প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দাবি করে বেদম মারধর ও দোকানে গুলি করার পর চকবাজার থানা পুলিশের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও সোহাগের জীবনের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। পুলিশ তাদের এমন নিষ্ক্রিয়তার জবাব এখনো দিতে পারেনি।
গতকাল কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শুধু হত্যা করেই থেমে থাকেনি সন্ত্রাসীরা। সোহাগের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও লাশের ওপর চলতে থাকে নৃশংসতা। হাসপাতালের ভেতরেই রক্তাক্ত নিথর দেহটি রাস্তার মাঝখানে ফেলে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে চলে ভয়াবহ উন্মত্ত উল্লাস। সোহাগকে হত্যার পর একজন নয়, একাধিক যুবক লাশের নাক-মুখে এবং বুকের ওপর একের পর এক আঘাত করে যেতে থাকে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা শুধু একটি হত্যাকাণ্ডই নয়; বরং চরম হিংস্রতার পরিচয় দিয়েছে।
গত বুধবার সন্ধ্যার কিছু আগে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল কম্পাউন্ডে শুরু হয় এক নৃশংস হত্যাকান্ড। চাঁদ মিয়া ওরফে সোহাগকে ধরে এনে সেখানে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার পর শরীরে ও মাথায় ইট-পাথর নিক্ষেপের পর নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে কম্পাউন্ডের বাইরের সড়কে এনে শত শত মানুষের সামনে উল্লাস করে। অথচ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা তখনো সচল, শত শত নার্স-রোগীও সেই দৃশ্য দেখেছেন। নিরাপত্তায় ছিলেন আনসার ক্যাম্পের সদস্যরাও। তবু এমন সন্ত্রাসের আতঙ্কে কেউ এগিয়ে আসেনি। যখন তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়, তখন চিকিৎসক জানান, আগেই মারা গেছেন সোহাগ।
স্থানীয়রা জানান, যারা এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা সবাই ইসহাকের সন্ত্রাসী বাহিনী। নিয়মিত চাঁদা আদায় করে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন। ওই এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে মূর্তিমান আতঙ্ক এ ইসহাক।
হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত যেখান থেকে : পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সোহাগের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নিতেন পলাশ ও তার লোকেরা। পরে এ চাঁদার ভাগ ১০ গুণ বাড়িয়ে সোগাগের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করেন ইসহাক ও তার লোকজন। সোহাগের কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মঙ্গলবার রাত ১১টায় ইসহাক তার লোকজনকে পাঠায়। নিজ প্রতিষ্ঠানে সোহাগকে বেধম মারধর করে এবং কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে। পরের দিন বুধবার বিকেলে আগের দিনের বিষয়টি মীমাংসার জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সোহাগকে ডেকে আনেন ইসহাকের লোকজন। এরপর হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতেই অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী সোহাগকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে। সোহাগের নিথর দেহ যখন পড়েছিল ঠিক তখনই লাশের ওপর উন্মাদের মতো পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে।
যেভাবে চলে চাঁদাবাজি : মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙ্গারি ব্যবসার সাথে পুরোনো বৈদ্যুতিক কেবল কেনাবেচার ব্যবসা করতেন সোহাগ। তার দোকানের নাম সোহানা মেটাল। ওই এলাকায় বিদ্যুতের তামার তার ও সাদা তারের ব্যবসার একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল সোহাগের। তবে নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল মাহমুদুল হাসান মহিন ও সারোয়ার হোসেন টিটু। এরপর এ সিন্ডিকেটের ভাঙন ধরিয়ে এর সাথে যুক্ত হন ইসহাক ও পলাশ গ্রুপ। এ দুই গ্রুপের মধ্যে পলাশকে আগে থেকেই চাঁদা দিয়ে আসছিল সোহাগ। মাসে ৩০ হাজার টাকা দিলেও মূলত ইসহাক ১০ গুণ বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। মাহমুদুল হাসান মহিন, সারোয়ার হোসেন টিটু ও চোরাই সিএনজির নিয়ন্ত্রক সিএনজি রনি আরেক সন্ত্রাসী মজনুর লোক। সোহাগ ত্রিমুখী গ্রুপের চাঁদা দাবির মুখে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়ে। অবৈধ বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল। তা না হলে নিয়মিত চাঁদা দেয়ার দাবি জানিয়েছিল তারা। এর জেরেই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেই দ্বন্দ্বে ঘটে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ঘটনার দিন সোহাগকে তার দোকান থেকে ডেকে আনা হয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদি হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত মাহমুদুল হাসান মহিন, সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাকিব, সাবা করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, মো: সিরাজুল ইসলাম, রবিন, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী, আনিসুর রহমান হাওলাদারসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়।
নিহতের ভাগ্নি মীম আক্তার জানান, তার মামার পরিচিত লোকজনই এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। তার মামা মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসা করতেন। কিন্তু টিটু, মহিনসহ স্থানীয় আরও কয়েকজন এ ব্যবসায় ভাগ বসাতে চাচ্ছিল। ওই প্রতিপক্ষের লোকজনও বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত। তিনি আরো জানান, গতকাল শুক্রবার বরগুনায় তার মামার লাশ দাফন সম্পন্ন করা হয়। তিনি বলেন, মামাকে তারা যেভাবে হত্যা করেছে তাদের বিচারও যেন দৃষ্টান্ত হয়। তবেই মামার আত্মা ও স্বজনরা শান্তি পাবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনের এডিসি আমিনুল কবির তরফদার বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক এবং ভয়াবহ। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে তদন্ত করছি। আসামিদের দ্রুত সময়ের মধ্যেই গ্রেফতার করা হবে। সোহাগকে আগের রাতে মারধর ও গুলির ঘটনার বিষয়ে পুলিশের ভূমিকা কী ছিল এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চকবাজার ও কোতোয়ালিতে এ ধরনের কোনো অভিযোগ দেয়া হয়নি। তার পরও আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছি।
হাসপাতালের ভেতরেই অস্ত্র-ইয়াবার সিন্ডিকেট : মিটফোর্ড এলাকায় অবৈধ গোডাউন ও অবৈধ ব্যবসা থাকায় সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে। এক নম্বর ও তিন নম্বর ভবনের ভেতরেই সিন্ডিকেট গড়ে মিটফোর্ড এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ। অস্ত্রের মজুদ ও ইয়াবাসহ মাদকের সিন্ডিকেট ওই দুই ভবনের ছাদে। নিয়োমিত আড্ডা ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয় ওই দুই ভবনের ছাদে বসেই। এর নিয়ন্ত্রক মঈন, তারেক, রিপন, সাজ্জাদসহ শতাধিক সন্ত্রাসী সেখানে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাজা সেবন করে আসছে। এমনকি তারা মাদকের ডিলারও। মিটফোর্ড এলাকায় ফুটপাত থেকে চাঁদা তুলে ইসহাক ও পলাশসহ অন্যন্য সন্ত্রাসী হোতের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা চলে।
মহিন-তারেকসহ চারজন গ্রেফতার : লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) খুনের ঘটনায় অস্ত্রসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব ও পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১), তারেক রহমান রবিন (২২) রয়েছে। অন্য দুইজনকে র্যাব গ্রেফতার করলেও তারা নাম প্রকাশ না করে অভিযান চলমান রয়েছে বলে জানানো হয়।
ডিএমপির ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা যায়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং পূর্বশত্রুতার জের ধরে উক্ত ঘটনা সংঘটিত হয়। ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এবং ঘটনার সাথে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
জামায়াতের নিন্দা
মো: সোহাগ নামে এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও শোক প্রকাশ করে এবং নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল এক বিবৃতি প্রদান করেছেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, গত ‘৯ জুলাই বুধবার বিকেলে ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে মো: সোহাগ নামে এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে মাথায় পাথর মেরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। হত্যা করে তারা শুধু সোহাগকে উলঙ্গই করেনি, তার লাশের ওপর নৃত্য করে আনন্দ উল্লাসও করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে মাথায় পাথর মেরে শত শত মানুষের সামনে এই হত্যার ঘটনা আইয়ামে জাহিলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। এই নির্মম দৃশ্য জাহেলিয়াতের লোমহর্ষক নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতাকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। পাশবিক এই হত্যার ঘটনায় মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এভাবে পাশবিক কায়দায় মানুষ হত্যা সভ্য সমাজে বিরল।
তিনি আরো বলেন, কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় এসেছে চকবাজার থানা যুবদলের কয়েকজন নেতা নিহত সোহাগের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না পেয়ে যুবদলের সন্ত্রাসীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। দেশবাসীর প্রশ্ন, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের লালন-পালনকারী দলের নেতারা যে রাজনীতির কথা বলে বেড়ায়, সেই দলের হাতে জনগণের জানমাল কতটা নিরাপদ? এই দলের হাতে ক্ষমতা গেলে দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র কখনোই নিরাপদ থাকতে পারে না। এই ঘটনায় আবার সেই পতিত ফ্যাসিবাদেরই পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সরকারকে এসব দুর্বৃত্তকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে এবং দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে নিহত সোহাগের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় এনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’