বাংলাদেশের অফিস, থানা-আদালতে একটি কথা খুব প্রচলিত, সেটি হলো- ‘উপরের নির্দেশ’। উপরের নির্দেশ কে কাকে দেয়, কি নির্দেশ দেয় তা নির্দেশদাতা আর নির্দেশিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো জানার বা বোঝার উপায় নেই। এই নির্দেশ আইনানুগ নাকি একান্তই ক্ষমতার তাপ সেটা সবাই বোঝেন, কিন্তু অসহায় মানুষের পক্ষে তার প্রতিকার চাওয়া প্রায় অসম্ভব।
আমাদের সমাজে একই আইন দু’ভাবে প্রয়োগ হয়। অর্থ-বিত্তের মালিক অর্থাৎ ক্ষমতাধরদের জন্য একভাবে আর ক্ষমতাহীনদের বেলায় অন্যভাবে। যদিও সংবিধানের ২৭ ধারায় বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ এটি শুধু সাংবিধানিক আইনে লেখা আছে কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনদের মধ্যে বিপরীতমুখী।
আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করি যেখানে কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দেয়া হয় কিন্তু সংবিধানের আইন মানা হয় না। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে আছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকার সংবিধানের বাইরে একচুলও সরতে নারাজ। সেই একই সরকার বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে সংবিধানের ৩৭ ধারা মানতে কোনোভাবেই প্রস্তুত নয়। সংবিধানকে দুই জায়গায় দু’ভাবে ব্যবহার করা কি জনগণের সাথে ভাঁওতাবাজি নয়?
একই দিনে একই সময়ে খুব কাছাকাছি জায়গায় দেশের বৃহৎ তিনটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ। এ ধরনের সমাবেশে লাখ লাখ লোকের জমায়েত হবে, এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কি এক আশ্চর্য কথা! পুলিশ সমাবেশে আসা লোকদের মোবাইল ফোন চেক করে যদি বিএনপিসংশ্লিষ্ট কোনো ছবি পায় তাহলে তার স্থান হয় থানাহাজত, তারপর এক বা একাধিক মামলা, সর্বশেষ কোর্ট হয়ে জেলহাজত। কাউকে কাউকে আবার রিমান্ড নামের অবর্ণনীয় নির্যাতন সইতে হয়। আওয়ামী লীগের লোকদের বেলায় আবার ভিন্ন চিত্র। লাঠিসোটা, দেশীয় অস্ত্র, বা অন্য কোনো অস্ত্র থাকলেও কোনো সমস্যা হয় না আওয়ামী লীগের ব্যানার-ফেস্টুন সংবলিত গাড়ি দেখলে সংবর্ধনার সাথেই তা ছেড়ে দেয়া হয়। কারো মোবাইলফোন চেক করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছবি পাওয়ার পর গ্রেফতার করেছে এমন নজির সাত জন্মেও কেউ খুঁজে পাবে না। পুলিশের এই দ্বৈত আচরণ নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সাথে কি সাংঘর্ষিক নয়?
বাংলাদেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক্ত পুলিশ রাষ্ট্রের বাহিনী না হয়ে বিরোধী দল দমনের বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। খুব কাছাকাছি দূরত্বের দু’টি সমাবেশের একটির সমাবেশস্থলের মোবাইল নেট, ইন্টারনেট লাইন বিচ্ছিন্ন, মাইকের তার কেটে দেয়া, বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে হাজার হাজার টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে মুহূর্তের মধ্যেই ১০ লাখের একটি সমাবেশকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়া রাষ্ট্রের কোন আইনের আওতায় হয়েছে জাতি তা জানতে চায়। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের সব সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগ সমাবেশ করল কিভাবে? এ প্রশ্ন রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে, পুলিশ যা করেছে তা কি নিজেদের ক্ষমতাবলে করেছে? নাকি উপরের তথা শাসকমণ্ডলীর নির্দেশে করেছে?
সরকারের প্রচারণা এমন যে, তারা যা করছে সবই উন্নয়ন আর গণতন্ত্র। পদ্মা সেতু, বড় বড় ব্রিজ, কালভার্ট, উড়াল সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদি করে সরকার উন্নয়নের বাহবা নিতে চাচ্ছে। কিন্তু এই উন্নয়নের অন্তরালে এই দেশের জনগণের কঠিন দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলছে, সরকার সেদিকে কর্ণপাত করছে না। মানুষের ভোটের অধিকার, বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে মানুষকে ভয়ের মধ্যে রেখে উন্নয়নের তকমা গণতন্ত্রহীন সমাজে একেবারেই মূল্যহীন।
বর্তমান সরকারের অগণতান্ত্রিক উন্নয়ন আর আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের উন্নয়নের চিত্র একই রকম। “আইয়ুব খান বিদায় গ্রহণকালে দেখলেন মৌলিক গণতন্ত্রের নামে নিজেকে যত বড় রাজনৈতিক নেতাই ভাবুন না কেন, বাস্তবে তার কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। সামরিক কর্মকর্তাদের সমর্থন ভিন্ন তিনি কিছুই না। আইয়ুব খান জনসমর্থন লাভের জন্য উন্নয়নের রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তিনি তার শাসনকালে ‘ডিকেট অব ডেভেলপমেন্ট’ আখ্যায়িত করেন। ভেবেছিলেন উন্নয়নমূলক কাজ দেখিয়ে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের মন জয় করতে পারবেন। মানুষকে অধিকার না দিয়ে মানুষের মন জয়ের চেষ্টা করা আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধি।” (মইনুল হোসেন, আমার জীবন আমাদের স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা নং-৭১)
আইয়ুব খান যেমন আর্মি-নির্ভর ছিলেন, শেখ হাসিনাও তেমনি পুলিশ-নির্ভর হয়ে পড়েছেন। পুলিশ প্রশাসন আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীর ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের মানুষ ঠিক বুঝতে পারছে না, পুলিশ রাষ্ট্রের কোনো বাহিনী নাকি আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গসংগঠন। ঠিক পুলিশি রাষ্ট্রের মতোই রাজপথের বিরোধী দলকে মোকাবেলা করার জন্য আওয়ামী লীগ দলীয় ক্যাডার বাহিনীর সাথে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করছে। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে টিয়ারশেল, জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে সভা ভণ্ডুল করার গুরুদায়িত্ব যেমন পুলিশ পালন করছে, তেমনি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের সবার নামে মামলা দিয়ে জেলে বন্দী করার দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করছে। সকাল-সন্ধ্যা কোর্ট বসিয়ে তাদের সাজা দেয়ার জন্য আদালতকেও সঠিকভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মী, সমর্থকরা এ দেশের নাগরিক নাকি পাসপোর্টবিহীন ভিন্ন কোনো দেশের নাগরিক তা তারা নিজেরাই বুঝতে পারছে না। কাউকে না পেলে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের ধরে এনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে, আবার নিষ্ঠুর কায়দায় নির্যাতনও করা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারের বর্তমান ভূমিকা ইসরাইলের ভূমিকায় পরিণত হয়েছে। ইসরাইল যেমন হামাস নিশ্চিহ্ন করতে চায়, তেমনি আওয়ামী লীগ সরকার এই দেশ থেকে বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করতে চায়। অর্থাৎ একদলীয় বাকশাল কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী রাজনীতিকে নিধন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কেউ অপরাধ করলে আইন-আদালতে তার বিচার হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সরকারের কেউ কেউ বলেন, যারা আগুন দিয়ে গাড়ি পোড়াবে, মানুষ মারবে, তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে। এটি সভ্য সমাজের উক্তি হতে পারে না। আগুন দিয়ে বাস পোড়ানো, মানুষ পোড়ানো খুবই ঘৃণ্য কাজ কিন্তু আইনের আওতায় না এনে তাদের পুড়িয়ে মেরে ফেলার হুকুম দেয়া কি বিনাবিচারে মানুষ হত্যা করার উসকানি নয়? পুলিশ পেট্রল ঢেলে বাসে আগুন দিচ্ছে এমন চিত্রের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ কর্তৃক বাসে আগুন ধরানোর চিত্রও আমরা দেখছি। তা হলে তাদের কেন পুড়িয়ে মারা হচ্ছে না? এখানেও নির্দেশের সাথে আচরণের পার্থক্য।
বর্তমানে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় ইস্যু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ চায় তাদের সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে আর বিএনপির দাবি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সরকার বিএনপির এই দাবি কিছুতেই মানতে নারাজ। তারা সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। অথচ ১৯৯৬ সালেও সংবিধানে সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা উল্লেখ ছিল। তখন আওয়ামী লীগ সংবিধান মানেনি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। অজুহাত ছিল মাগুরার উপনির্বাচনের ত্রুটি। আওয়ামী লীগের ভাষায়, তাদের আন্দোলন ছিল যৌক্তিক। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দু’টি জাতীয় নির্বাচনসহ দেশের গোটা নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলেছে। জনগণের কাছে নির্বাচনের বিশ^াসযোগ্যতা মাইনাসের ঘরে নিয়ে এসেছে। এখন একটি বিশ^াসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেখানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে এমন একটি নির্বাচন করার জন্য বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, আওয়ামী লীগের ভাষায়, বিএনপির এই দাবি অসাংবিধানিক। আওয়ামী লীগের মনোভাব হলো, তারা যা করবে তা আইনসম্মত। অন্যরা যা করবে তা অসাংবিধানিক। আইনের এই বৈষম্যমূলক প্রয়োগ আওয়ামী লীগকে স্বেচ্ছাচারীর তকমায় ভূষিত করেছে।
দু’-একটি অগণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী সরকার ব্যতীত সারা দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক সরকার ও দাতা দেশ বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেই চাপ উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একতরফা নির্বাচনের ফলাফল যে সুখকর হবে না তা হয়তো নির্বাচনের পরই উপলব্ধি করতে হবে। এর খেসারত রাষ্ট্র ও জনগণকেই দিতে হবে। প্রকৃত অর্থে উপলব্ধির বিষয় হলো, নিজেদের ইচ্ছামাফিক আইনের প্রয়োগ না করে জনগণের সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন করা উচিত। দেশবাসী একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। সব রাজনৈতিক দলের উচিত জনগণের এই চাওয়ার প্রতি সম্মান জানানো।
harun_980@yahoo.com