সাদাকালো

বামপন্থিদের বেগার খাটা আর কতদিন?

জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রক্ষণশীল শক্তিগুলোর ভূমিকা প্রধান হলেও বামপন্থিদের অবদান নেহাত কম নয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলভুক্ত বাম দলগুলো ছাড়া বাকি সবাই এতে অংশগ্রহণ করেছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ ধারায় চলা গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত কিছু দলকেও সংশ্লিষ্ট নেতাদের রাজনৈতিক অতীতের কারণে মানুষ ‘বামপন্থি’ বলেই ডাকে। বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলগুলোও এ গণঅভ্যুত্থানে নিজেদের মতো শামিল ছিল। বিশেষ করে এদের ছাত্র সংগঠনগুলো অভ্যুত্থানের মূল প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বেশ সক্রিয় ছিল।

যে শিক্ষক নেটওয়ার্ক আন্দোলনের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে সচেতন মহলের নজর কেড়েছে, সেখানেও মূলত বামধারার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রাধান্য। ১৯ জুলাই সরকার কারফিউ জারির পর একটু মিইয়ে পড়া আন্দোলনকে বিশেষত রাজধানীতে চাঙ্গা রাখতে যেসব সংগঠনকে দেখা গেছে, সেখানে ছিল কয়েকটি বামপন্থি সাংস্কৃতিক সংগঠন। পরবর্তী সময়ে সংস্কৃতিজগতের অনেক জনপ্রিয় তারকাও যে ওই আন্দোলনে নেমে আসেন, তারও পেছনে ভূমিকা রাখেন বাম ধারার শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা।
গত দেড় দশকে বিএনপি ও তার মিত্ররা বহুবার চেষ্টা করেও শেখ হাসিনার সরকারকে টলাতে পারেনি। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা মাত্র দু’মাসে সে কাজটিই করে দেখিয়েছে। শেষোক্তদের এ সাফল্যের সূত্র হিসেবে প্রায় সব পর্যবেক্ষকই মূলত ব্যাপক হতাহতের ঘটনার কথা বলেন, যা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছাড়াও শ্রমজীবী মানুষকে তাড়িত করেছে। তবে বহু পর্যবেক্ষক এর জন্য ডানপন্থিদের সঙ্গে প্রায় সর্বস্তরের বামপন্থিদের মঞ্চ ভাগাভাগিতে উৎসাহিত করতে আন্দোলনের সংগঠকদের দক্ষতাকেও কৃতিত্ব দেন।
ইতিহাস সাক্ষী, সেই ১৯৫২ সাল থেকে এ ভূখণ্ডে যুগান্তকারী যত ঘটনা ঘটেছে, তার সবক’টাতেই বামপন্থিদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। অনস্বীকার্য, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিরা প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে তা ভিন্ন এক আলোচনা, যার সুযোগ অন্তত এ পরিসরে নেই। তারপরও মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিদের ভূমিকা তাৎপর্যহীন নয়।

আমার বক্তব্য হলো, স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে কোনো সফল গণআন্দোলনই বামপন্থিদের বাদ দিয়ে সম্ভবপর হয়নি। সর্বশেষ গণঅভ্যুত্থানও প্রমাণ করল, সংগঠিত শক্তি হিসেবে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার পরও বামপন্থিদের স্পর্শ ছাড়া তা সর্বাত্মক রূপ পেত না। আন্দোলনে যেসব গান ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বহুল ব্যবহৃত; এগুলোর রচয়িতারা যেমন, তেমনি যারা এ পর্যায়ে তুলে এনেছিলেন তারাও প্রধানত বামপন্থি বলেই পরিচিত। সে সময় দেয়ালে দেয়ালে আঁকা ও লেখা গ্রাফিতি, স্লোগানগুলোর কথা মনে করুন, প্রায় সবই বামচিন্তার প্রতিফলন।
অস্বীকার করা যাবে না, অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও বাম রাজনীতিতে আসে সমাজের অপেক্ষাকৃত মেধাবী, অগ্রসর মন ও মননের ধারক তরুণ-তরুণী। বিশেষত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে এদের গ্রহণযোগ্যতা উল্লেখযোগ্য। জাতীয় রাজনীতিতেও, ইতোমধ্যে অনেকের বিচ্যুতি সত্ত্বেও, অন্তত সততা ও ত্যাগের দিক থেকে বাম নেতাদের ভাবমূর্তি অন্য ধারার রাজনীতিকদের চেয়ে বেশি। এ কারণেই গত কয়েক দশকে বামপন্থি দলগুলো নানা কারণে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তি হারালেও, অন্তত আন্দোলনের মাঠে তাদের কদর কমেনি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতার রাজনীতির দুই দিকপালেরই তরফ থেকে বামপন্থিদের নিয়ে টানাটানি চলে। এবারের গণঅভ্যুত্থানেও একই সূত্র ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, এবারও কি বামপন্থিরা অন্যের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হলো? প্রথমত, গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে স্থানপ্রাপ্তি তো নয়ই, এমনকি সরকার গঠনের আলোচনায়ও বামপন্থিদের কারও নাম উচ্চারিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে ছয়টি কমিশনের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করলেও সেগুলোতে বামপন্থিদের সংখ্যা নগণ্য। আর শিক্ষাক্রম পুনর্মূল্যায়ন কমিটি নিয়ে যা হলো, তা তো রীতিমতো কেলেঙ্কারি। গঠিত কমিটিতে বামমনা দু’জন শিক্ষককে রাখা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে প্রধানত ডানপন্থি বিভিন্ন গোষ্ঠী এমন আক্রমণ শানায়, এক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা পুরো কমিটিই বাতিল করে দেন।

লক্ষণীয়, এহেন বাড়িতে ডেকে এনে অপমান সত্ত্বেও বামপন্থিরা খুব জোরালোভাবে এর সমালোচনা করতে পারেনি। তবে তাদের আরও গুরুতর ব্যর্থতা হলো, গণঅভ্যুত্থান বামপন্থার জন্য যে রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করেছে, তা তারা ধরতে পারেনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ বনাম ধর্মমিশ্রিত জাতীয়তাবাদ বিভাজন রাজনীতি-সচেতন কারও অজানা নয়। এটাকে নিছক সেক্যুলার বনাম নন-সেক্যুলার ধারার বিরোধরূপেও বর্ণনা করা যায়। যেভাবেই চরিত্রায়ন করা হোক, এখানে প্রথম ভাগে আছে আওয়ামী লীগ ও বামধারার দলগুলো; বিপরীতে আছে বিএনপি-জামায়াত ও অন্যান্য রক্ষণশীল দল। এটাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজনরূপেও দেখা হয়।
মনে রাখতে হবে, এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলার কারণেই বামপন্থিরা নিজেদের সম্পর্কে যাই বলুক, প্রধানত ডান শিবিরের কাছে আওয়ামী শিবিরভুক্ত বলে বিবেচিত হয়। যেমন, ১৯৭২ সালের সংবিধানকে শুধু আওয়ামী লীগই নয়, অধিকাংশ বাম দল– কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও আদর্শ সংবিধান মনে করে। সেখানে বর্ণিত চার মূলনীতিকে বামপন্থিরাও সমর্থন করে। অন্যকিছু বাদ; শুধু জাতীয় সংগীতের কথাই ধরুন। বামপন্থিরা আওয়ামী লীগের মতোই এর সুরক্ষায় সচেষ্ট। অন্যদিকে জামায়াত বা ধর্মভিত্তিক দলগুলো তো বটেই, এমনকি বিএনপিও এর পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে রাজি নয়।
এখন কথা হলো, অন্তত একই উদারমনা সমর্থক গোষ্ঠীনির্ভর হওয়ার কারণে বামপন্থিরা বরাবরই তাদের বিকাশের পথে আওয়ামী লীগকে বাধা মনে করে। তাই তারা বিভিন্ন সময়ে লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনীতি করলেও গত কয়েক দশক যাবৎ দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙার আওয়াজ তুলে একলা চলো নীতিতে চলে আসছে।

আজকে যখন গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় আওয়ামী লীগ দল হিসেবে বিপর্যস্ত, তখন বামপন্থিদের সুযোগ ছিল সেক্যুলার ধারার মানুষদের নিজেদের দলে টানার। বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রতীকের ওপর যখন হামলা চলছে, এমনকি ইসলামের উদারপন্থি ধারা সুফি তরিকার স্থাপনা ও মানুষের ওপর যখন হামলা চলছে; তখন বামপন্থিরা তাদের পক্ষে সীমিত শক্তি নিয়েই দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও বামপন্থিদের মাঠে থাকার সুযোগ ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বীহীন হওয়ায় বামপন্থিরা হয়তো তাদের দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত বিকল্প হয়ে ওঠার পথও পেত।
বাস্তবে সেটা না করে বামপন্থিরা অন্যদের মতোই নিছক বুলি কপচানোতে ব্যস্ত। সম্ভবত অন্যদের মতো তারাও ভাবছে, এ সরকার বিব্রত হয় তেমন কিছু করা যাবে না। কিন্তু যেখানে খোদ সরকারপ্রধান বলছেন, জনগণকে মন খুলে তাদের সমালোচনা করতে; যেন সরকার নিজের ভুলগুলো শোধরাতে পারে, সেখানে উদারমনা এমনকি শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার এমন সুযোগ হারানোর যুক্তি কী হতে পারে? তবে কি বেগার খাটাই বামপন্থিদের নিয়তি?

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews