সাবরিনা সুলতানা তিশা

‘মা’ শব্দটি পৃথিবীর সবচেয়ে কোমল, শক্তিশালী ও গভীরতম ভালোবাসার প্রতীক। মাতৃত্ব একজন নারীর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও জীববৈজ্ঞানিক রূপান্তরও। কিন্তু যখন এই মাতৃত্ব আসে একজন তরুণী শিক্ষার্থীর জীবনে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে, তখন সেটি হয়ে দাঁড়ায় একদিকে অপার আনন্দ, অপরদিকে নীরব সংগ্রাম। সমাজ যেমন ‘মা’ শব্দটিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে, শিক্ষাঙ্গন অনেক সময় ততটাই বিমুখ থাকে শিক্ষার্থীর মাতৃত্ব বাস্তবতা গ্রহণে।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক ছাত্রী সামাজিক ও পারিবারিক কারণে বিবাহিত হন এবং অনেকের মাতৃত্ব আসে শিক্ষাজীবনের মধ্যেই। যদিও আমাদের সমাজে বিয়ের পরে সন্তান হওয়া স্বাভাবিক একটি ধারা, তবে একজন ছাত্রী যখন মা হন, তখন চারপাশের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চোখে সে হয়ে যায় ‘ব্যতিক্রমী’ কিংবা ‘সমস্যার শিক্ষার্থী’। অনেকেই মাতৃত্বের খবর গোপন রাখেন সামাজিক ভয়ে, অনেকে ক্লাস বা পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হন শারীরিক দুর্বলতা ও নবজাতকের দায়িত্বের কারণে।

২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবাহিত নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান ধারণ করেন। এটি নিছক একটি পরিসংখ্যান নয়- এটি বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই বাস্তবতার কোনো প্রস্তুতি নেই। নেই মাতৃত্বকালীন ছুটি, নেই ডে-কেয়ার সুবিধা, নেই শ্রেণীকক্ষে উপস্থিতির বিকল্প পদ্ধতি, নেই পরীক্ষার তারিখে নমনীয়তা।

শুধু কি অবকাঠামোর অভাব? না, তার চেয়েও বড় সমস্যা দৃষ্টিভঙ্গির। একজন মা শিক্ষার্থীকে সহানুভূতির চোখে না দেখে, অনেক সময় কর্তৃপক্ষ ও সহপাঠীদের কাছে হয়ে ওঠেন হাস্যরস বা সহানুভূতিহীন আলোচনার বিষয়। অথচ মাতৃত্ব কোনো ব্যর্থতা নয়, এটি একটি জীবনের স্বাভাবিক ও গৌরবময় অধ্যায়। একজন ছাত্রী মা হওয়ায় তার মেধা, দক্ষতা কিংবা উচ্চশিক্ষার সম্ভাবনা একটুও কমে না; বরং দায়িত্বশীলতা ও আত্মত্যাগের শিক্ষায় সে হয়ে ওঠে আরো পরিণত।

উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী মায়েদের জন্য রয়েছে আলাদা নীতিমালা ও সুবিধা। যেমন- মাতৃত্বকালীন ছুটি, ক্লাসের ভিডিও রেকর্ডিং, শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং নমনীয় পরীক্ষার তারিখ। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী মায়ের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সহজ হয়। বাংলাদেশেও এমন ব্যবস্থা চালু করা এখন সময়ের দাবি।

একজন মা শিক্ষার্থী যেন গর্ভাবস্থার কারণে হোস্টেল থেকে বের হয়ে না যেতে হয় এবং শুধু মাতৃত্বের জন্য যেন তার বছর নষ্ট না হয় বা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পরতে না হয়- এমন মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এতে যেমন নারী শিক্ষার্থীর অধিকার নিশ্চিত হবে, তেমনি সমাজও উপকৃত হবে একটি সহনশীল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মাতৃত্ব সহনীয় পরিবেশ’ গড়ে তুলতে প্রথমেই প্রয়োজন নীতিগত স্বীকৃতি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উচিত ‘শিক্ষার্থী মাতৃত্ব’কে নীতিগতভাবে স্বীকৃতি দিয়ে নির্দেশনা জারি করা। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-

১. ডে-কেয়ার সুবিধা : প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ডে-কেয়ার চালু করা যেতে পারে। শুধু ডে-কেয়ার চালু করলেই হবে না; বরং সেখানে শিশুর জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ডে-কেয়ারের ফিস এমন নির্ধারণ করতে হবে যেন মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীরাও তার ব্যয়ভার বহন করতে পারে।

২. ক্লাস-পরীক্ষায় নমনীয়তা : গর্ভাবস্থায় কিংবা সদ্য মা হওয়া অবস্থায় ক্লাস ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেয়া উচিত। অসুস্থতার কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারলে তাকে পুরো এক বছর গ্যাপ দেয়ার পরিবর্তে পরবর্তীতে তাকে মেকআপ এক্সাম দেয়ার সুযোগ করে দেয়া উচিত। ক্লাসে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রেও নমনীয়তা প্রদর্শন জরুরি।

৩. ক্লাস উপস্থিতি ও মূল্যায়নের বিকল্প পদ্ধতি : যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে উপস্থিতির হারের উপর নির্দিষ্ট নম্বর থাকে, সেহেতু অনেক শিক্ষার্থী শারীরিক অসুস্থতা ও নবজাতকের দায়িত্বের কারণে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে না পারায় সেই নম্বরের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় তাদের জন্য শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির বিকল্প পদ্ধতি চালু করা উচিত। প্রতিদিন ক্লাসে উপস্থিতির পরিবর্তে তার থেকে একদিন প্রেজেন্টেশন বা ভাইভা নিয়ে তার ভিত্তিতে ক্লাস উপস্থিতির নম্বর দেয়া যেতে পারে। অথবা অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে বসে ক্লাসে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ক্লাস ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত যেটা থেকে তারা উপকৃত হতে পারে। শিক্ষক ও প্রশাসনের মধ্যে এ বিষয়গুলোতে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি, যাতে একজন শিক্ষার্থী মা নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে না করেন।

৪. মাতৃত্বকালীন ছুটি : বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রীদের জন্য গর্ভকালীন এবং প্রসূতিযোগ্য ছুটি দেয়ার নিয়ম চালু করতে হবে। শিক্ষা জীবনের সাথে মাতৃত্ব কোনো বিরোধ নয়; বরং দু’টি অভিজ্ঞতা একে অপরকে পরিপূর্ণ করে। একজন নারী যেন মায়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে বাধ্য না হন, সেটিই হওয়া উচিত আমাদের সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার মানবিক রূপ। মাতৃত্ব যেন উচ্চশিক্ষার পথে বাধা না হয়ে; বরং এক নতুন পথের সঙ্গী হয়- এই আশা নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষা আর মাতৃত্ব যেন পরস্পরের শত্রু না হয়; বরং শক্তি হয়ে উঠুক।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews