শিক্ষকতা পেশায় আসছেন না মেধাবীরা। ফলে আগামী দিনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের সঙ্কট তৈরির আশঙ্কা করছেন এ খাতের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে শিক্ষকদের বেতনকাঠামো এবং পেশাগত সম্মানের দিক দিয়েও তারা আগের মতো এখন আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। এ ছাড়াও আধুনিক যুগে পেশার বৈচিত্র্যতাও মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশা থেকে দূরে রাখছে। বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে নতুন পেশার দিকেই ঝুঁকছেন তরুণ প্রজন্ম। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠানে এক লাখের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য থাকলেও এসব পদে আবেদন জমা পড়েছে মাত্র ৫৭ হাজার ৮৪০টি। অর্থাৎ পদ থাকলেও যোগ্য মেধাবী প্রার্থীদের আগ্রহ না থাকায় অর্ধেক পদ এবারো পূরণ হচ্ছে না।
সর্বশেষ তথ্য মতে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সময় গত দুই দিন আগে শেষ হয়েছে। এখানে টাকা জমার শেষ সময় ছিল ১৩ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত। প্রকৃত অর্থে আবেদনের সাথে ফি জমার ভিত্তিতে আবেদনকারীদের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়। শেষ মুহূর্তে কত আবেদন পড়ল তা জানার আগ্রহও থাকে প্রার্থীদের। এবার শেষ মুহূর্তে এক লাখের বেশি শিক্ষক পদের বিপরীতে মোট ৫৭ হাজার ৮৪০ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন। সর্বশেষ রোববার রাত পর্যন্ত ফি জমার ভিত্তিতে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র মতে, ষষ্ঠ নিয়োগ সুপারিশ বিজ্ঞপ্তিতে ১৩ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত আবেদনের টাকা জমা দেয়া গেছে। এর আগে ১০ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত এই আবেদন জমা শেষ হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি দেখভাল করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে মাধ্যমিক (হাইস্কুল) পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ে মেধাবী শিক্ষক পাওয়া যায় না। একই সাথে শরীর চর্চা শিক্ষক এবং মাদরাসার জন্য মৌলভী ও কারি পদের জন্যও যোগ্য মেধাবী প্রার্থী পাওয়া যায় না। সম্প্রতি শূন্য পদে নতুন করে যোগ হয়েছে মাধ্যমিকের চারু-কারু পদের শিক্ষক সঙ্কট। শুধু এই চারু কারু পদেই ১৩ হাজার পদ শূন্য হয়েছে। অথচ যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থীরা এই পদে আসছেন না।
এনটিআরসিএর তথ্য উপাত্ত বলছে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা না এলেও কম মেধাবী কিংবা দুর্বল প্রার্থীরা অন্য পেশায় প্রবেশের সুযোগ না পেয়ে তারা কিন্তু ঠিকই শিক্ষকতার এই পেশায় আসতে মরিয়া হয়েই চেষ্টা-তদবির করছেন। বিগত দিনে এনটিআরসিএর প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় যে ফলাফল তাতে দেখা গেছে পরীক্ষায় পাসের জন্য ন্যূনতম ৪০ নম্বরও অনেক প্রার্থী অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরবর্তীতে ভাইভা অন্যান্য পরীক্ষায়ও বাদ পড়ে যায় প্রার্থীদের বড় একটি অংশ। ফলে প্রতিযোগিতার শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা প্রার্থীদের সংখ্যা নিতান্তই কম। ফলে বাধ্য হয়ে কম মেধাবীদেরই নিয়োগ দিতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান নয়া দিগন্তকে বলেন শিক্ষকদের বেতনকাঠামোই মেধাবীদের এই পেশার দিকে আকৃষ্ট করছে না। একই সাথে সম্মানের দিক দিয়েও আগের মতো শিক্ষকদের সেই মর্যাদা সমুন্নত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একই সাথে বর্তমান এই বিশ্বায়নের যুগে পেশার বৈচিত্র্যতা বা প্রতিযোগিতাও মেধাবীদের ভিন্ন ভিন্ন পেশা বেছে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তবে একথা ঠিক যে, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে না পারলে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য শুভকর কোনো ফল বয়ে আনবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখনই নেয়া জরুরি বলে আমি মনে করি।
অন্য দিকে এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মফিজুর রহমান গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, মেধাবীরা যদি শিক্ষকতা পেশায় না আসেন তাহলে তো বাধ্য হয়েই কম মেধাবী বা অযোগ্যরাই এই পেশায় স্থান করে নেবে। এটা আমাদের জন্য মোটেই সুখকর কোনো সংবাদ নয়। মাধ্যমিকের বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ের উপযুক্ত দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়েও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এক লাখ শিক্ষকের পদ খালি থাকলেও এসব পদে আমরা শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার জন্য যে পরীক্ষা নিয়েছি সেখানে দেখা গেছে ৪০ শতাংশ প্রার্র্থীই ফেল করেছে। এতে প্রমাণ হয় মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইছে না।
সূত্র জানায় সারা দেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ১ লাখ ৮২২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার লক্ষ্যে ষষ্ঠ নিয়োগ সুপারিশ প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। গত ২২ জুন থেকে শুরু হওয়া এই আবেদন চলে ১০ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত। প্রকাশিত ষষ্ঠ নিয়োগ সুপারিশ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট এক লাখ ৮২২টি এমপিওভুক্ত শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজে ৪৬ হাজার ২১১টি, মাদরাসায় ৫৩ হাজার ৫০১টি এবং কারিগরি ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ১১০টি পদ রয়েছে।