ফিরেদেখা

৭ নভেম্বরের বিপ্লব ও ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান এক সূত্রে গাঁথা

বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পরিচিত ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমরা ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের কথা শুনেছি। তখন ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির জন্য সিপাহিরা বেরিয়ে এসেছিল।

আর ৭ নভেম্বরে একইভাবে বাংলাদেশের সাধারণ সিপাহিরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান, অনিশ্চয়তা, অরাজকতা এবং প্রতিবেশী শক্তির হীন ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতা যখন বিপন্ন তখন তারা চেইন অব কমান্ড বা নির্দেশের সোপানকে অগ্রাহ্য করে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় অবতীর্ণ হন। তারা জাতীয় শক্রদের প্রতিহত করে কুচক্রীদের নীলনকশা নস্যাৎ করে দেন। সমসাময়িক পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংহতি অর্জনে এ রকম সংহত, সমন্বিত এবং সংগঠিত ঐক্য গোটা জাতির জন্য এক অনুপম দৃষ্টান্ত। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, কিছু ঘটনা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পটভূমি তৈরি করেছিল। মধ্য আগস্টের রক্তক্ষয়ী ঘটনাবলি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বলয়ে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্ট করেছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই ‘পরাজিত শক্তি’ ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চালায়। এ সময়ে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে জ্যেষ্ঠ বনাম কনিষ্ঠদের মাঝে কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। এ দ্বন্দ্ব একটি হস্তক্ষেপপ্রবণ পরিস্থিতির তৈরি করে। শত্রুরা এর সুযোগ গ্রহণ করে। তাদের পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৫ আগস্ট ঘটনাবলির পরে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত খন্দকার মোশতাক কোনোমতেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিলেন না।

তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীকে তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। এমএজি ওসমানী দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সাধনে সর্বাত্মক চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে ঢাকা সেনানিবাসে জ্যেষ্ঠদের পাল্লা ভারী হয়ে ওঠে। সেই সময় সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তাঁর অনুগত ছিলেন তৎকালীন ঢাকা ব্রিগেডপ্রধান কর্নেল শাফায়াত জামিল। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তারিখে এদের সম্মিলিত শক্তি ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পাল্টা আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। 

সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের অভিযোগ তুলে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সংঘটিত করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেই নির্দেশের সোপান ভেঙে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করলেন এবং নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করলেন। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে গোপনীয়ভাবে কর্মরত ছিল জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। তারা এ অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ লাভের জন্য তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রধান কর্নেল তাহের তাদের পরিকল্পিত বিপ্লবের জন্য এই অস্থির ও অরাজক অবস্থাকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা যথেষ্ট সক্রিয় থাকলেও সেনাবাহিনীতে তাদের ব্যাপক সমর্থন ছিল না। স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা এবং সাধারণ সৈনিকদের প্রতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সহানুভূতিশীল ভূমিকার কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল প্রশ্নাতীত। তাই কর্নেল তাহের তাদের প্রত্যাশিত বিপ্লবের জন্য জিয়াউর রহমানের কাঁধে সওয়ার হওয়ার পরিকল্পনা নেন। ঘটনার এক পর্যায়ে তাহের বাহিনী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে তাদের তত্ত্বাবধানে নেওয়ার একাধিকবার চেষ্টা করে। জিয়াউর রহমান তাঁর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এসব কূটকৌশল মোকাবিলা করেন। 

৭ নভেম্বরের বিপ্লব জেনারেল জিয়াউর রহমানকে যুগের এক সন্ধিক্ষণে মোড় ফেরানো রাজনৈতিক নেতৃত্বের চূড়ায় অধিষ্ঠিত করেছিল অপ্রত্যাশিতভাবে। লক্ষ্যণীয়, তিনি প্রত্যক্ষভাবে ১৫ আগস্টের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান, ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থান কিংবা ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব; কোনোটার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না। অথচ ঘটনার পরম্পরায় ৭ নভেম্বরের বিপ্লব তাঁকে নিয়ে আসে নেতৃত্বের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁর পেশাদারি মনোভাব, অকৃত্রিম দেশপ্রেম ও সর্বজনগ্রহণযোগ্যতার সুনামের কারণে আপামর সিপাহি-জনতা তাঁকে সেই ক্রান্তিলগ্নের ত্রাতা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ৭ নভেম্বর থেকে সংগৃহীত চেতনা ও বিশ্বাসকে তিনি ধারণ করেছিলেন তাঁর কথায় ও কাজে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির দার্শনিক ভিত্তি স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল সেই ক্ষণেই।

৭ নভেম্বরের বিপ্লব থেকে আহরিত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার প্রত্যয়ে সংবিধান ও জাতীয় মূলনীতিগুলো পুনর্নির্ধারণ করে দিয়েছিলন। পরবর্তী সময়ে বৈরী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর তরফ থেকে আনা শত পরিবর্তন ও ইতিহাস বিকৃতির পরও তাঁর নেওয়া বিবিধ কর্মসূচি ও আদর্শিক ভিত্তির ধারাবাহিকতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আজও প্রবহমান দেখতে পাই। সে কারণে যথাযথভাবেই তাঁকে আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি বলা হয়। শহীদ জিয়াউর রহমানের পক্ষ থেকে গোটা জাতির জন্য সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বলতম উপহার বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন। সমসাময়িক পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে তিনি বাংলাদেশে বিলুপ্ত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু করেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রচলন করেন। কিন্তু গত দেড় দশকে আমরা দেখেছি, দেশের গণতন্ত্র কতটা বিপন্ন হয়। যে গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের মানুষ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা, তা ব্যক্তিতন্ত্রের নিগড়ে পতিত হয়। গণতন্ত্র মূল্যবোধ হিসেবে যেমন ভূলুণ্ঠিত হয়। জনগণের মৌলিক অধিকার অস্বীকৃত আর তাদের সতত স্বাভাবিক ভোটাধিকার ভয়াবহ রকমের নির্বাচন প্রকৌশলের কাছে ভীষণভাবে পরাজিত। ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর যে বিপ্লবের চেতনা আমাদের বিপন্ন স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখণ্ডতাকে নিশ্চিত করেছে; সেই বিপ্লবী ধারায়ই সংঘটিত হলো এ বছরের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান।

বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সেই বিপ্লবের সঙ্গে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক ধরনের মিল রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রভাব এবং পার্শ্ববর্তী দেশের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা জেগেছিল। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী জনআকাঙ্ক্ষা বুঝতে পেরেছিল। পরিস্থিতি বুঝে সেনাপ্রধান বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেনা-জনতার ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত, তাদের চেষ্টায় সংস্কারপূর্বক জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আগামীতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা তৈরি হবে। প্রতিনিধিত্বশীল সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে দেশ শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

ড. আবদুল লতিফ মাসুম: প্রাক্তন অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews