কিছু দিন আগে জরুরি তলব পেয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে গিয়ে দেখি ১৮ বছরের এক টগবগে তরুণ মাথায় ও সারা শরীরে অসংখ্য আঘাত নিয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাকে বাঁচিয়ে রাখতে। আঘাতে তার মাথা এবং মুখ থেঁতলে গেছে। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ডানপাশের চোখ। নাকে রক্ত ঝরছে। মুখের চোয়াল চূর্ণবিচূর্ণ।

জানা গেল, এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার খুশিতে বাবা তাকে একটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন। চালানোর দক্ষতা না থাকায় মোটরসাইকেলের প্রথম যাত্রায় সরাসরি চলে যান গাড়ির চাকার নিচে, সেখান থেকে হাসপাতালের বিছানায়।

ছেলেটি প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে থাকার পর বেঁচে ফিরে গেছে। কিন্তু আগের সেই দৈহিক সৌন্দর্য হারিয়ে, অসংখ্য সেলাইয়ের দাগ এবং একচোখে নামকাওয়াস্তে দৃষ্টিশক্তি নিয়ে। মাঝ থেকে চিকিৎসায় প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকার ধকল পরিবারকে সইতে হলো।

রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকে, এ ধরনের রোগীদের সেবায়। বেশির ভাগ রোগীই বাড়ি ফিরে যায়, সাথে নিয়ে যায় চিরস্থায়ী অঙ্গহানি ও পঙ্গুত্ব এবং অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে। তারা গোটা পরিবারকে আর্থিকভাবে পথে বসিয়ে দেয়। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্য দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এগুলোতে সার্বিক চিত্র পাওয়া যায় না। সরকারিভাবে এ তথ্য অস্বীকার করা বা কমিয়ে দেখানোর প্রবণতা তো আছেই। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্যচিত্র বিবেচনা করা যেতে পারে। তাদের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৩১ হাজার ৫৭৮ জন। এর বিপরীতে কতজন আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন এ হিসাব কারো কাছে নেই।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার হিসাবে, ২০২৪ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫৪৯৫, যা ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক বেশি। আরো আগের হিসাবের তুলনা করলে দেখা যায় সড়ক দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এবং আহত হওয়ার হার প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান। শুধু মোটরসাইকেল মোট দুর্ঘটনার ২৫.২৪ শতাংশ দখল করে আছে। মোটরসাইকেল এবং পণ্যবাহী বাসের কারণে মোট ৫১.৭৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এর সাথে থ্রি হুইলার যোগ করলে মোট দুর্ঘটনার ৭০.৩১ শতাংশ ঘটে থাকে। মোটরসাইকেল ও থ্রি হুইলার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ৪৩.৭৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। এর সাথে পণ্যবাহিত ট্রাক নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ৭০.৩১ শতাংশ দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। সারা বছর দুর্ঘটনাজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সারা বছরের বৈদেশিক অনুদানের চেয়েও বেশি। বার্ষিক পরিকল্পনাকারীরা বার্ষিক ব্যয় বরাদ্দ নির্ধারণ করতে গিয়ে এ হিসাব রাখেন কি না তা অবশ্য জানা যায়নি। যাই হোক, জীবনহানি, পঙ্গুত্ববরণ, চাকরি হারানোর শঙ্কা জাতীয় কর্মঘণ্টার অপচয় সর্বোপরি ব্যক্তিগত পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ওপর অবাঞ্ছিত ক্রমবর্ধমান চাপ প্রতিহতো করা না গেলে শুধু সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা আছে।

গাড়ির উচ্চগতি এবং ওভারটেক করার প্রবণতা সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এর সাথে রয়েছে সড়ক আইন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাব। সড়কের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা বেশির ভাগ গাড়ি চালকেরই নেই। বিআরটিএ’র বিরুদ্ধে চালকদের যোগ্যতার যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স দেয়ার অভিযোগ পুরনো। অবশ্য তারাও রয়েছেন বিপদে। তাদের ভৌত স্থাপনা, লোকবল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে এর উচ্চগতি নিয়ন্ত্রণের একটি নিয়ম দরকার। মোটরসাইকেল চালকের অবশ্যই ড্রাইভিং লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করতে হবে। মোটরসাইকেল ব্যবসায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কারো কাছে মোটরসাইকেল বিক্রি করতে পারবে না এমন আইন থাকা দরকার।

থ্রি হুইলারের যন্ত্রণায় এখন পথ চলা দায়। বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলা এসব যান এখন শহর, গ্রাম সর্বত্রই নাগরিক যন্ত্রণার কারণ। বিদ্যুৎ সঙ্কটের এটাও একটি কারণ। সড়কের ধারণক্ষমতার বাইরে গাড়ির চাপ এক দিকে যেমন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অপর দিকে তেমন কমাছে রাস্তার স্থায়িত্ব। এরপর রয়েছে রাস্তার ওপর হাটবাজার বসানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এর থেকে স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও মাস্তানবাহিনী যোগ রয়েছে। সওজের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও এর সাথে জড়িত বলে শ্রুতি রয়েছে।

সড়কের শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিতদের সংখ্যা কম। অন্য দিকে তারা ভুগছেন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকলে তারা কাজ করবেন কীভাবে? মোটা দাগে বলতে গেলে এ দেশের শহর ও গ্রামের সড়ক পথ এখন ভাসমান দোকানদার ও অবৈধ যন্ত্রদানবের দখলে। জনসাধারণের জন্য তৈরি ফুটপাথে আজ তাদের চলার জায়গা নেই। অথচ তাদেরই বহন করতে হয় ট্যাক্সের বোঝা। সড়কে নিরাপদ চলাচলের দাবিতে অতীতে অনেক আন্দোলন হয়েছে। অথচ অবস্থার উন্নতির পরিবর্তে কেবল অবনতিই চোখে পড়ছে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews