একাধিকবার জনবিদ্রোহে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। জনপ্রত্যাশা পূরণের প্রতিশ্রতি দিয়ে যারাই আবার ক্ষমতায় এসেছে তারাও স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন না আসলে বার বার ব্যর্থ হবে শহীদের আত্মাহুতি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এই সরকারের ওপর দেশবাসীর প্রত্যাশাÑ নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থাকে স্বৈরাচারী ধারা থেকে একটি জনবান্ধব সরকার ব্যবস্থায় প্রবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করছে দেশবাসী। সরকার ব্যবস্থায় একক ব্যক্তির ক্ষমতা ও কালো টাকার নিকট পরাজিত হচ্ছে সকল জনআকাক্সক্ষা। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার হলে সরকার ব্যবস্থাও পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। দেশে অনেকগুলো স্তরে নির্বাচন হয়। যেমন; জাতীয় সংসদ নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনে রাষ্ট্রের অনেক ব্যয় হয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৪শত ৪৫ কোটি টাকা, একাদশ, দশম, নবম, অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৭শত কোটি, ৪শত ১৭কোটি, ১শত ৬৫.৫ কোটি, ৭২.৭১ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ১ম সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল মাত্র ৮১.৩১ লক্ষ টাকা। ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে ৭শত কোটি টাকা। ৫ম, ৪র্থ ও ৩য় উপজেলা নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল যথাক্রমে ৬শত ৭৭ কোটি, ৩শত ৫৫ কোটি ও ১শত ৩৩ কোটি টাকা। অন্যান্য নির্বাচনের ব্যয়ও কম নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নির্বাচন কমিশনের সামগ্রিক সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৭শত ৬৯ কোটি টাকা। প্রতি বছরই রাষ্ট্রের ও ব্যক্তির নির্বাচনী ব্যয় বাড়ছে। নির্বাচনে ব্যয় বাড়লেও আস্থার স্থান শূন্য। সরকারের এক ঘোষণায় কোটি কোটি টাকার ব্যয়ের নির্বাচনি ফলাফল বাতিল করা হয়েছে। পানি নিয়ে দেশ শুকনো মৌসুমে হাহাকার করে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ৮ হাজার ২শত ১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করা যায়। দেশের ২/৩টি সামগ্রিক নির্বাচনের ব্যয় দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা ব্যারেজ বা অন্য কোনো মেগা প্রকল্প সহজেই করা সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচনগুলি দলীয় সরকারের অধীনেই হয়েছে কিন্তু জনসমর্থন পায়নি। আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল করে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসছে। সরকার ব্যবস্থা একঘর থেকে আরেক ঘরে পৌঁছাবার জন্য আর নির্বাচন নয়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অন্তর্বর্তী সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমেই ৫ বছরের নির্বাচন একদিনে একই খরচে একটি সমন্বিত নির্বাচন পরিচালনা ব্যবস্থার অধীনে করা সম্ভব।

সমৃদ্ধ ও সৌহার্দ্যরে বাংলাদেশ গড়ার জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রয়োজন। দেশবাসীর জন্য সমন্বিত নির্বাচন ও সরকারের ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা নি¤েœ উল্লেখ করছি।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি, জেলা কমিটি ও উপজেলা কমিটি নিয়মিত সম্মেলন বা কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠন করতে হবে।

সকল সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়াত্তশাসিত প্রতিষ্ঠিানের কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিরত অবস্থায় এবং পূর্ণ অবসরের ২ বছরের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলের সভ্য হতে পারবে না।

সরকারি বেতন ও ভাতা গ্রহণকারীকে প্রতি বছর সম্পদের বিবরণ ও আয়কর রিটার্র্ন জমা দিতে হবে। দায়িত্ব হস্তান্তর বা পদত্যাগ বা বরখাস্ত বা আবসরে যাবার প্রাক্কালে সম্পদের বিবরণ স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের ওয়েব সাইটে সাধারণের জন্য প্রকাশ করতে হবে।
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের জন্য দলীয় রাজনীতির নিষিদ্ধ করতে হবে।

কোন ব্যক্তি দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবে না। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই সাথে দুই পদে থাকতে পারবে না।

সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থা, কালো টাকা, সন্ত্রাসী ও অসৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাছে বার বার হার মানছে বাংলাদেশ। সৎ, নির্ভিক ও নির্লোভ ব্যক্তিরা দিনে দিনে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অনেক জ্ঞানী ও দক্ষ ব্যক্তি নির্বাচনী দৌড়ে হেরে যাচ্ছে অথবা প্রার্থী হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় জনপ্রতিনিধির পদগুলো দখল করছে কালো টাকার মালিক আর রাজনীতির লেবাসধারী সন্ত্রাসীরা। প্রচলিত ব্যবস্থায় নির্বাচনে প্রতিটি ভোটের মূল্যায়ন হয় না। ভোট কেন্দ্রে ভোটার ভোট দিতে আসে না। সরকার ব্যবস্থায় প্রধানত দ্বিদলীয় ব্যবস্থার অবসানের জন্য সাধারণ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের সংসদীয় আসন নির্ধারণ করতে হবে আনুপাতিক ভোট প্রাপ্তির মাধ্যমে।

যে রাজনৈতিক দল আনুপাতিক হারে সর্বোচ্চ ভোট পাবে ঐ রাজনৈতিক দলের মনোনীত সংসদ সদস্যগণ রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদের স্পিকার মনোনয়ন দেবেন। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ডেপুটি স্পিকারের পদে মনোনয়ন দেবে।

নির্বাচনের পূর্বে প্রতিটি রাজনৈতিক দল পাঁচ বছরের জন্য দেশবাসীর কাছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রদান করবে। দলের জন্য মনোনীত সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং কমপক্ষে ২০ সদস্যের মন্ত্রী পরিষদ সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ ঘোষণা করবে। সরকারি ব্যয়ে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলির বক্তব্য নির্ধারিত ফরমে প্রচার করার ব্যবস্থা করবে।

রাজনৈতিক দল আনুপাতিক হারে প্রাপ্ত আসনের ২০ শতাংশ আসনে নারী সদস্য মনোনীত করবে।

নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে। কোনো রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদের ন্যূনতম ১টি আসন লাভ করেতে না পারলে ঐ দল পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। নির্বাচনের পরে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে সমঝোতা করে সরকার গঠন করা যাবে। বৃহত্তম দল বা জোট নেতা সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করবে। স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনের ব্যবস্থা কোনো স্তরেই থাকবে না।

নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনের প্রাথমিক শাখা হবে ওয়ার্ড। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হবেন ঐ এলাকার সংখ্যাধিক্য ভোট প্রাপ্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। কোন পর্যায়ে সমভোট প্রাপ্ত হলে, প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে পরবর্তী উচ্চ ধাপের সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রেক্ষিতে (যেমন: সাধারণ ওয়ার্ডে সমান ভোট প্রাপ্ত হলে, সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলের সাধারণ ওয়ার্ডের সদস্য মনোনীত হবে)। উপজেলায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত করার সুযোগ পাবে।

পাঁচ বছর পর পর মেয়াদ শেষে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রী পরিষদ, সকল সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের পদ বিলুপ্ত হবে। রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনধিক ছয় মাসের মধ্যে প্রশাসনে নিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি করে একই নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।

সংসদ সদস্য, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্যানেল প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় নির্বাচন করবে।
পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্যানেল প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জেলা কমিটি/সমমানের কমিটি নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় নির্বাচন করবে।
ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যগণের প্যানেল প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উপজেলা কমিটি নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় নির্বাচন করবে।

লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক
[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews