শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। বিগত কয়েক বছরে সে মেরুদণ্ডকে দুমড়ে মুচড়ে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যা আর অপারেশন করে ঠিক করার পর্যায়ে নেই। এখন নতুন মেরুদণ্ড প্রতিস্থাপন করা ছাড়া বিকল্প নেই। আগের আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভালই চলছিল দেশ। হঠাৎ রাজনীতিবিদদের মাথায় চাপলো, বিভাগ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করবেন। কোনো শিক্ষাবিদ বা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে না জানিয়েই অনেকটা রাতের আঁধারে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় ভাগ করে শুরু হলো নতুন ব্যবস্থা।

তারপর শুরু হলো পরীক্ষা পদ্ধতি দিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে নতুন খেলা। এ পদ্ধতিতে দেখা গেল, আকাশের সব তারকা বাংলাদেশে ঝরে পড়ল। ওটাও ছিল রাজনীতির খেলার মতো একটা খেলা। এ খেলায় রেফারির ভূমিকাায় ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বোর্ডের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেয়া হলো, পাশের হার বাড়াতে হবে। কীভাবে? পরীক্ষকগণকে সেভাবে খাতা দেখার নির্দেশ দেয়া হলো। ব্যস্, খেল খতম (প্রধান পরীক্ষক আত্মীয়-স্বজন থাকলে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন)। ফলাফল যা হবার, তাই হলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে এসে বেরিয় পড়ল থলের বিড়াল। অধিকাংশ তারকারই উজ্জ্বলতা নেই, ভূয়া প্রমাণিত হলো। এক লাইন ইংরেজি লিখতে ৫টা ভুল।
তারপর আবার পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন। এবার এমসসিকউ এবং গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হল। ছেলে-মেয়েরা আবারও হলো রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের ল্যাবের গিনিপিগ। এবার দেখা গেল, এ+ পাওয়ার ছড়াছড়ি। কিন্তু পড়াশোনার গুণগত মান নিন্মমুখী। পরীক্ষায় পাশের হার বেশি দেখানোর সেই কেরামতি বহাল থাকল। তদুপরি ৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে শুরু হলো পাবলিক পরীক্ষা। কয়েক বছর চলার পর আবার বন্ধ করে দেয়া হলো। পরীক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে পাগলামির খেলা চলছে গত ১৫ বছর ধরে।

পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যে বার বার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে, এর সঙ্গে যারা শিক্ষা, শিক্ষানীতি ও পাঠক্রম, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদের মতামত ও অভিজ্ঞতাকে কখনও কাজে লাগানোর লক্ষণ বা প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে একটি চেয়ার আছে, যা হলো মহাপরিচালকের। ওই চেয়ারে যিনিই বসেন, তিনিই মহাবিজ্ঞ পন্ডিত হয়ে উঠেন, যাকে দিয়ে এ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। ওই মহাবিজ্ঞই পাঠক্রম, সে অনুযায়ী পাঠ্য বই লেখা, পরীক্ষা পদ্ধতি ঠিক করেন (কার নির্দেশে, তা অজানা)। ওই মহাবিজ্ঞকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, আপনি কি জানেন, এ দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সমপর্যায়ে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় কোথায়ও পাবলিক পরীক্ষা নাই? যুক্তরাজ্যে কেমব্রিজ ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলে, যা বিশ্বের সকল দেশ কর্তৃক স্বীকৃত, সেখানে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের প্রত্যেকটিতে মাত্র ৩টি বিষয়ে বাধ্যতামূলক ও একটি বিষয়ে ঐচ্ছিক পরীক্ষা নেয়া হয়? যেখানে এ দেশে মাধ্যমিকে ১২ ও উচ্চ মাধ্যমিকে ১১টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়।

অতি সম্প্রতি আবার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিভাগভিত্তিক পদ্ধতি পরিবর্তন করে আগের আমলের একক পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি আমদানি করা হয়েছে সুদূর ফিনল্যান্ড থেকে। নতুনভাবে আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে আমাদের ছেলে-মেয়েদের উপর। ইতোমধ্যে এ পদ্ধতির বিরুদ্ধে নাকি আবার অভিভাবকদের আন্দোলনও শুরু হয়েছে।

এবার আসা যাক উচ্চ শিক্ষা নিয়ে, একই গোষ্ঠির তোঘলকী কাণ্ড। আমাদের স্বাধীনতার সময় সরকারি কলেজ ছিল মাত্র ৩২টি, বিশ্ববিদ্যালয়য় ছিল ৪টি। কয়েকটি বেসরকারি কলেজ ছিল ঈর্ষণীয় সাফল্যের শিখরে। তার মধ্যে একটি ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ। ঐ কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন বিখ্যাত আইসিএস অফিসার, কুমিল্লা বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান। তার ছাত্র হিসাবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। ১৯৭৫ এর আগস্ট সরকারি কলেজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪-এ, ১৯৮১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১০২, ১৯৯০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০৯ এবং ১৯৯৫ এর ডিসেম্বরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২২২টিতে। এ হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের প্রথম দিকের শাসনামলে যেখানে মাত্র ২টি বেসররকারি ডিগ্রি কলেজ সরকারিকরণ করা হয়, সেখানে বিএনপির প্রথম ৬ বছরে ৬৮টি, জাতীয় পার্টির সাড়ে নয় বছরে ১০৭টি, বিএনপির বিগত ৫ বছরে ১৩টি বেসরকারি কলেজ সরকারি করা হয়। কোনো সুষ্ঠু নীতিমালার পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারিকরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় (সূত্র: সরকারি কলেজসমূহে শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরি, পৃষ্ঠা ৪২, বিবেকের জানালা, ড. সুলতান আহমদ, প্রকাশকাল, ২০০৮)।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এবং সরকারি সাহায্যের পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার মানের চরম অবনতি অব্যাহত রয়েছে। এক সময়ের নাম করা সরকারি কলেজ চট্টগ্রাাম, রাজশাহী, সিলেট সরকারি কলেজের যে সুনাম ছিল, বর্তমানে তা অজ পাড়াগাঁয়ের যে কোনো সরকারি কলেজের সমমানে পৌঁছেছে।

বর্তমানে দেশে ১৬৮৮টি সরকারি কলেজ আছে। এগুলোর অনেকগুলোতে আবার অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সও পড়ানো হয়। পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক, ল্যাব সরঞ্জামের অভাবে এসব কলেজে মানহীন শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষিত বেকার সৃষ্টিতে অবদান অব্যাহত রেখেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব কোর্স পড়ানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে ও অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্বববিদ্যালয় (মাধ্য্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডগুলোর মতো) এ স্তরের শিক্ষার পরীক্ষা পরিচালনা ও সার্টিফিকেট বিতরণের প্রতিষ্ঠান।

১৯৭১ সালে যেখানে দেশে ছিল মাত্র ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে ২০২৩ এ ৫৩টি পাবলিক, ৭টি কৃষি, ৫টি ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫টি মেডিকেল ও ১৪টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নামের আড়ালে সব বিষয়ই পড়ানো হয়) আছে। আরও কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ পাইপ লাইনে আছে। আরও আছে ১০৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত সমস্যা নাই বললেই চলে। তবে সমস্যা হলো মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য মানসম্মত শিক্ষকের অভাব।

অবগতির জন্য জানাচ্ছি, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যের মতো দেশে কোনো মেডিকেল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নাই। যুক্তরাজ্যে কোনো টেক বিশ্ববিদ্যালয় নাই। আমেরিকাতে ১২ ও অস্ট্রেলিয়াতে ২টি টেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

সবশেষে, উচ্চ ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আমার নিজস্ব পরিকল্পপনা হলো: (১) প্রত্যেক স্কুলে কেজি-এর অনুরূপ প্রি-স্কুল (৬ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য) সব স্কুলে চালু করা (বিভাগ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করার ফলে অতিরিক্ত শিক্ষকদের দিয়ে এই কোর্স চালান সম্ভব)। (২) এ শিক্ষাকে ৩ টায়ারে ভাগ করা। (৩) প্রথম টায়ার হবে ১ম হতে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। এতে শিক্ষা দেয়া হবে ৩ আর (পড়া, লেখা ও মৌলিক গণিত), শিক্ষা ও জীবন যাপনের জন্য সাধারণ জ্ঞান প্রদান। এ পর্যায়ে কোনো পরীক্ষা থাকবে না। (৪) ৭ম ও ৮ম শ্রেণি: এখানে শিক্ষার মূল ভিত শিক্ষা দেয়া হবে। (৫) এটা হবে ৯ম হতে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। ৯ম শ্রেণিতে ভর্তির সময় ৩টি মূল ও ১টি ঐচ্ছিক বিষয় শিক্ষার্থী পছন্দ করবে। দু’বছর পর ওই পছন্দের বিষয়সমূহে (চারটি বিষয়ে) পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হবে। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির সময় অনুরূপ চারটি বিষয় পছন্দ করতে হবে এবং দু’ বছর পর ওই চারটি বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews