জুলাই অভ্যুত্থানের পরে ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসা ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি এখন সংকটাপন্ন। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত শুক্রবার জুমার নামাজের পরে নির্বাচনি প্রচার চালানোর সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসকরা বলছেন, হাদির কানের একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মস্তিষ্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করার পর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন ওসমান হাদি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিনই এই ঘটনা অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারা হাদিকে কী উদ্দেশ্যে গুলি করলো—সেটি যেমন প্রশ্ন, তেমনি হাদিকে হত্যাচেষ্টা নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের অংশ, নাকি এরকম আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাকে টার্গেট কিলিংয়ের জন্য এটি একটি ‘টেস্ট কেস’—সেই আলোচনাও জোরদার হচ্ছে।

এই ঘটনার পরদিন শনিবার হাদিকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে গণঅধিকার পরিষদের নেতা রাশেদ খান বলেন, অন্তত ৫০ জনকে হত্যার টার্গেট করা হয়েছে। এর পেছনে তিনি অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে দাবি করেছেন। প্রশ্ন হলো, এই আশঙ্কা যদি সত্যিই হয় যে, হাদিকে হত্যাচেষ্টা কিছু টার্গেট কিলিংয়ের টেস্ট কেস, তাহলে এর মধ্য দিয়ে খুনিরা কী অর্জন রতে চায়? শুধুই কি নির্বাচন বানচাল করা নাকি এর পেছনে আরও বড় কোনো উদ্দেশ্য আছে? নির্বাচন বাচনাল হলে কার লাভ কার ক্ষতি? নির্বাচন বানচাল হলে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে গেলে যাদের লাভ, হাদির ওপর হামলায় তাদের কোনো ইন্ধন রয়েছে কি না বা রাজনৈতিক বিভক্তির সুযোগ গিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ এই ঘটনা ঘটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় কি না এবং সেই তৃতীয় পক্ষ কারা আর মাছটিরই বা কী নাম? দেশি-বিদেশি কোনো শক্তি কি দেশে একটি চরম অস্থিরতা তৈরি করে তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়?

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফিরতে না পারার পেছনে যেহেতু তার নিরাপত্তা সংকটই প্রধান কারণ বলে মনে করা হয় বা তার বক্তব্যেও যেহেতু বিষয়টা পরিষ্কার, ফলে তার দেশে ফেরাটা আরও বেশি অনিশ্চিত করে তোলার জন্য তথা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য হাদির ওপর হামলা একটি বড় সংকেত কি না—জনপরিসরে এরকম একটি ধারণাও আছে। আর এ কারণেই হয়তো হাদির ওপর যেদিন হামলা হলো সেদিন রাতেই বিএনপির মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে তারেক রহমানের দেশে ফেরার সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেছেন। এতদিন তার দেশে ফেরার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ না করে বলা হতো যে, তিনি শিগ্‌গিরই দেশে ফিরবেন। এরপর বলা হলো, নভেম্বরে আসবেন। তারপর বলা হলো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে। সবশেষ দলের একজন নেতা বলেছিলেন, বিজয়ের মাসেই তিনি আসবেন। কিন্তু দলের মহাসচিব জনালেন, ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন তারেক রহমান। অর্থাৎ যেদিন হাদিকে হত্যার জন্য খুব কাছ থেকে গুলি করা হলো, সেদিনই তারেক রহমানের দেশে ফেরার সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণাটিও একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা। ‍

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ঢাকা-৮ আসনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে গত ১২ ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পরে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছিলেন হাদি। কিন্তু অটোরিকশায় যাওয়ার পথে তাকে অনুসরণ করে আসা একটি মোটরসাইকেল থেকে তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সাথে সাথে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয় এবং সন্ধ্যার দিকে সেখানে তার অপারেশন হয়। অপারেশন শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, হাদির অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। অপারেশন চলাকালে ওসমান হাদির দুবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় বলেও জানান চিকিৎসক। এ অবস্থায় পরিবারের ইচ্ছায় ওইদিন রাত আটটার দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে। যে হাসপাতালে এ মুহূর্তে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও চিকিৎসাধীন।

এই ঘটনায় দ্রুতই অপরাধীদের গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দেয় হাদির সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চ। বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এই ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং এই ঘটনাটি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করে। কারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে তা নিয়ে নানাজন নানা মন্তব্য করেন। তবে ইনকিলাব মঞ্চ এই ঘটনায় সরাসরি কাউকে দোষারোপ না করলেও তারা কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখছে না বলে জানায়।

এই ঘটনার কিছু সময় পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগঠন-ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েমের একটি ফেসবুক পোস্ট বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাদিক কায়েম তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ওসমান হাদিকে গুলি করা হলো। চাঁদাবাজ ও গ্যাংস্টারদের কবল থেকে ঢাকা সিটিকে মুক্ত করতে অচিরেই আমাদের অভ্যুত্থান শুরু হবে। রাজধানীর ছাত্র-জনতাকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।’

অভ্যুত্থানের পরে দেশ যেহেতু একটি ভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভেতরে ঢুকে গেছে, সেসব বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনে যারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের জয়লাভ করুক না কেন, অন্তত এবারের সরকারটি জাতীয় সরকার মডেলে হলে দেশি-বিদেশি সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে। কারণ নির্বাচনের পরে গঠিত সরকারকেও যদি আবার রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে আন্দোলন ও বিক্ষোভ মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার পথে দেশকে পরিচালিত করা বেশ কঠিন হবে।

কিন্তু এই তার পোস্ট নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। কারণ জনমনে প্রশ্ন ওঠে, তিনি কি জানেন কারা হাদিকে গুলি করেছে? অনেকেই মনে করেন, সাদিক কায়েম হয়তো ঢাকা ৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে ইঙ্গিত করেছেন। এই আসন থেকেই সাদিক কায়েম জামায়াতের প্রার্থী হতে পারেন—এমন গুঞ্জনও আছে। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মির্জা আব্বাস সাথে সাথেই ঢাকা মেডিকেল যান হাদিকে দেখতে। অবশ্য সেখানে গিয়ে তিনি ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন। এদিন রাতে তারেক রহমানে দেশে ফেরার ঘোষণা দেয়ার পরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা মেডিকেলে মির্জা আব্বাসকে ঘিরে একধরনের মব সৃষ্টির প্রতিবাদ জানান এবং ভবিষ্যতে বিএনপির কোনো নেতা বা প্রার্থীর সঙ্গে এইধরনের আচরণ করা হলে কঠোর জবাব দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন।

পরদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে বানানো একটি ছবির বরাত দিয়ে হাদির ওপর হামলাকারী সন্দেহভাজন ব্যক্তি জামায়াত শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত বলে মন্তব্য করেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী। যদিও ভুল বুঝতে পেরে পরে তিনি এর জন্য দুঃখপ্রকাশ করে বিৃবতি দেন।

হাদির ওপরে কে গুলি করেছে, সেই ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী খুঁজে বের করবে—এই প্রত্যাশা সুস্থ বোধসম্পন্ন সকল মানুষেরই। হাদি সুস্থ হয়ে আবারও রাজনীতির মাঠে ফিরবেন, সুস্থ নির্বাচনি প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন—এই প্রত্যাশাও মানুষের আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি জরুরি এটা জানা যে, সত্যিই হাদির ওপর এই হামলাটি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র কি না?

মনে রাখতে হবে, ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত নির্বাচনটি বিগত দিনের ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো নয়। পরপর তিনটি নির্বাচনে এই দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তারা একটি অবাধ-সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে আছে। যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকার দেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা শুরু করবে এবং অভ্যুত্থানের পরে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের যে প্রত্যাশা জনমনে তৈরি হয়েছে, সেই প্রত্যাশা পূরণে কাজ শুরু করবে।

অনির্বাচিত সরকারের আমলে দেশ সব সময়ই অস্থির থাকে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে না। নানারকম ডেভিল ফোর্স বা অশুভ শক্তি সোচ্চার হয়। তারা নিজেদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। তাছাড়া অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে প্রতিবেশী ও বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় থাকে না। অনেক জায়গায় ছন্দপতন ঘটে। সাধারণ মানুষ একধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশ ও মানুষের স্বার্থে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

এই নির্বাচনটি বানচাল হয়ে গেলে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে গেলে দেশ এখন যে সংকটে আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সংকটে নিপতিত হবে। সুতরাং রাজনৈতিক আদর্শ, দর্শন ও কর্মসূচি ভিন্ন হলেও এই মুহূর্তে ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বারবার জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, সেই ঐক্যে যে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে, তা নানা ঘটনায় স্পষ্ট। কিন্তু এখন অন্তত হাদির এই ঘটনার পরে সেই ফাটল দূর করা জরুরি।

মনে রাখতে হবে, নির্বাচন বানচাল করে বা পিছিয়ে দিয়ে কেউ যদি রাজনৈতিক ফায়দা নেবে বলে মনে করে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। বরং নির্বাচন না হলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন সব পরিস্থিতি দেশে তৈরি হবে যা হয়তো আমাদের কল্পনারও অতীত। অতএব যে-কোনো মূল্যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে হবে। আর অভ্যুত্থানের পরে দেশ যেহেতু একটি ভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভেতরে ঢুকে গেছে, সেসব বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনে যারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের জয়লাভ করুক না কেন, অন্তত এবারের সরকারটি জাতীয় সরকার মডেলে হলে দেশি-বিদেশি সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে। কারণ নির্বাচনের পরে গঠিত সরকারকেও যদি আবার রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে আন্দোলন ও বিক্ষোভ মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার পথে দেশকে পরিচালিত করা বেশ কঠিন হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/জেআইএম



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews