অর্ন্তবর্তী সরকারের এক বছর পূর্তিতে সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব মেলাচ্ছে সরকার এবং দেশের মানুষ। অর্ন্তবর্তী সরকার কোনো রাজনৈতিক সরকার নয়। কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা কিংবা নির্বাচনী মেনিফেস্টো নিয়ে এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। এ অর্থে সরকারের কোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি কিংবা গতানুগতিক দায়বদ্ধতা নেই। তবে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার জীবন ও রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের যে গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ও রাষ্ট্র মেরামতের প্রতিশ্রুতি ছিল, তা বাস্তবায়নে এ সরকারের দায়বদ্ধতা যেকোনো নির্বাচিত সরকারের চেয়ে বেশি। সকল রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত পদক্ষেপ থাকলে সরকার শুরুতেই একটি বিপ্লবী সরকার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারতো। সে ক্ষেত্রে প্রচলিত সংবিধান স্থগিত করে স্বল্প সময়ে একটি গণপরিষদ নির্বাচন করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে পুরনো জঞ্জাল অপসারণ করা হয়তো আরো সহজ ও ত্বরান্বিত হতো। সেটা সম্ভব না হওয়ায় পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা উভয়সংকটে নিপতিত হয়েছে। একদিকে জুলাই বিপ্লবীদের রাষ্ট্র সংস্কারের আকাক্সক্ষা. অন্যদিকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর যথাশীঘ্র নির্বাচনের তাগিদ এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মাঠের রাজনীতিতে মাঠ গরম করা বক্তৃতাবাজি, বিবৃতি ও পরস্পরের প্রতি আক্রমণাত্মক ভূমিকা আড়ালে থাকা পতিত স্বৈরাচারের দোসর ও এজেন্টদের তাদের গোপণ অভিসন্ধি বাস্তবায়নে উৎসাহিত করেছে। অর্ন্তবর্তী সরকারের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি, বদনাম রটানো, দেশকে অস্থিতিশীল করে সরকারের স্বাভাবিক কাজকর্মের গতিশীলতা বিনষ্ট করার সাথে সাথে সুযোগ বুঝে সরকারের গদি টলটলায়মান করে তোলার এজেন্ডা বেশিরভাগ ব্যর্থ হলেও তাদের অর্জনও নেহাত কম নয়। প্রথমত: বিপ্লবকে অভ্যুত্থানে নামিয়ে আনা, দ্বিতীয়ত জুলাই অভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন ঘোষণাকে এক বছর ধরে বিলম্বিত করা এবং অনেক দরকষাকষির পর জুলাই বিপ্লবের নেতাদের চরম হতাশায় ঠেলে দিয়ে একটা অসম্পুর্ণ, কিছুটা দায়সারা গোছের জুলাই সনদ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তড়িঘড়ি নির্বাচনের টাইম-লাইন ঘোষণার মধ্য দিয়ে অর্ন্তবর্তী সরকার তাদের এক বছরের দায়িত্ব শেষ করেছে। চব্বিশের ৫ আগস্ট হাসনাত, নাহিদ, সারজিস, আখতার, জারা, সজিব, মাহফুজদের নেতৃত্বে শত শত শহীদের প্রাণের বিনিময়ে সংঘটিত অভ্যুত্থানে আঞ্চলিক পরাশক্তির বিপুল সমর্থনপুষ্ট ১৬ বছরের ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের পতনের ক্ষণটিকে সেসব প্রথম সারির জুলাই যোদ্ধারা উদযাপন করতে পারেনি। মানিকমিয়া এভিনিউ এবং জাতীয় সংসদ ভবনের চত্ত্বরে যখন লাখো মানুষের হর্ষধ্বনি ও আনন্দ র্যালিতে মুখরিত জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা তখন ঢাকার বাইরে কক্সবাজারে অবকাশ যাপনের ভণিতা করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারি যোদ্ধারা যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, তা দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন কিংবা বিপ্লবের প্রতিশ্রুতির মত কোনো চিহ্ন কিংবা শক্তিশালী বার্তা দিতে পারেনি। দুর্বল আত্মপ্রকাশ এবং অর্ন্তবর্তী সরকারের আনুকূল্যের কারণে অনেকেই এনসিপিকে কিংস পার্টি বলতে দ্বিধা করছে না। যে ছাত্র-জনতা একটি প্রবল ফেরাউনি স্বৈরাচারের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক সব শক্তির বিরুদ্ধে সিসাঢালা প্রাচীরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষের রক্তের প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে এক অবিশ্বাস্য বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল; অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মতভেদ ও বিভাজনের কারণে অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারি ছাত্র-জনতার নেতারা কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন ও দুর্র্বল রাজনৈতিক শক্তিতে পরিনত হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের শুরুতেই ভারতে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা, দিল্লির সরকারের মুখপাত্র, ভারতের সেনাপ্রধান এবং আমেরিকায় থাকা শেখ হাসিনার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় অভিন্ন স্বরে বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের দাবি তুলেছিলেন। সেই সাথে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিও দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলেছিল। তবে এই দুই পক্ষের নির্বাচনের দাবির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যে এক নয়, তা সহজেই অনুমেয়। সর্বোচ্চ জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ে ক্ষমতায় যাওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র মেরামতসহ তাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে ভারত গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার গলা চেপে ধরে, পশ্চিমা বিশ্বের আহ্বান ও বিশ্বজনমতকে অগ্রাহ্য করে অগণতান্ত্রিক পন্থায় আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে পরপর চারটি ভুয়া নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হাসিনাকে নব্য ফেরাউনে পরিনত করেছিল, হাসিনার পতনের পর তাকে দিল্লিতে আশ্রয় দিয়ে ভারত একদিকে দ্রুত নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা বলেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হাসিনাকে পুনর্বাসিত করার নানামুখী তৎপরতার ইন্ধন দিয়েছে। অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অর্ন্তবর্তী সরকার এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলো পতিত স্বৈরাচারের দোসর ও পৃষ্ঠপোষকদের ষড়যন্ত্র একের পর এক নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। গত এক বছরে এটা প্রমাণিত হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তি ও স্পিরিট কোনো একটি বিশেষ রাজনীতিক দল বা গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি দেশের সব রাজনৈতিক শক্তি এবং দলনিরপেক্ষ ছাত্র-জনতার মধ্যে জাগরুক রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক কাঁদাছোড়াছড়ি কিংবা অবিশ্বাস-অনাস্থার কাছাকাছি পরিস্থিতি দেখা গেলেও শাহবাগে, সচিবালয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতিত স্বৈরাচারের সমর্থক ও নিষিদ্ধ সংগঠনের নৈরাজ্য সৃষ্টির অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ছাত্র-জনতার সময় লাগেনি। ইসকন, সংখ্যালঘু কার্ড, আনসারের সচিবালয় দখলের চেষ্টা কিংবা হাসিনার বসানো আমলাদের অচলাবস্থা সৃষ্টির মরিয়া উদ্যোগগুলো ব্যর্থ করে দিতে না পারলে অর্ন্তবর্তী সরকার এখন জুলাই সনদ কিংবা জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারতো না। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে অনেকটা ফারাক থাকলেও জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার ট্রেনকে ওরা লাইনচ্যুত করতে পারেনি। তবে এক-এগারোর মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যহত করার অপপ্রয়াস এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ এখনো আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এক বক্তব্যে এমন আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ না থাকলে আরেকটি এক-এগারো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যা, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, গুম-খুন, ম্যাস-কিলিং, পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাসাকার, শাপলা চত্ত্বর গণহত্যা থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার ঘটনার সাথে ভারতীয় এজেন্টদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। মূলত স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের উপর সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পেছনে ভারতীয়রা আওয়ামী লীগের উপর একচ্ছত্রভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের সাথে ভারতের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও সম্পর্কের কেমিস্ট্রিকে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনো মানদ-েই ফেলা যায় না। ভারতের হাজার কৃষক ও হাজার ব্যবসায়ীর অস্তিত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থ, শত শত কোটি ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের চেয়েও হাসিনা ও ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের নিরাপত্তা ভারতের ডিপ-স্টেটের কাছে যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ফ্যাক্টস-ফাইন্ডিং রিপোর্টে জুলাই গণহত্যার প্রধান অনুঘটক তথা নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার অকাট্য তথ্য-প্রমাণ দেয়া হয়েছে। তার আগেই শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে দিল্লীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল ঢাকা। সে চিঠির কোনো জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে না চাইলে তার ব্যাখ্যা এবং তার মুখ বন্ধ রাখা বা উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দিয়ে সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের পথ বেছে নেয়া থেকে তাকে বিরত রাখতেও দিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানুষের যেসব গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার সাথে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, সেসব কোনো যৌক্তিক বা মানবিক দাবির প্রতি ভারত অসহযোগিতামূলক আচরণ অব্যাহত রেখেছে। গত ১৫ বছর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার, ও মানবাধিকারের প্রশ্নে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের অবিরাম আন্দোলন সাথে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন সত্ত্বেও একে একে চারটি জাতীয় নির্বাচন ভারতীয় নীলনকশা অনুসারে বাস্তবায়িত হয়েছে। এ থেকে বাংলাদেশের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব সহজেই আঁচ করা যায়। জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়াসহ পরবর্তী সকল কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশের উপর তার আধিপত্য রক্ষার বেপরোয়া মনোভাবের বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছে। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাসহ গুরুতর অপরাধি হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে ভারতে আশ্রয় দিয়ে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, পশ্চিমবঙ্গে আওয়ামী লীগের অফিস খুলে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর ব্যবস্থা করেছে। ফ্যাসিবাদী মগজধোলাই প্রাপ্ত নেতাকর্মী ছাড়াও সেনাবাহিনীতে, পুলিশে, আমলাতন্ত্রে থাকা স্বৈরাচারের দোসর ও ভারতীয় এজেন্টরা দেশকে অস্থিতিশীল করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাতের চর্তুমুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসিদের তা-ব থেকে বোঝা যায়, সন্ত্রাস- নৈরাজ্যের পুরনো চেহারা নিয়েই গা ঢাকা দিয়ে আছে। ঢাকায় আওয়ামী লীগ কর্মীদের গেরিলা ট্রেনিং দেয়ার অভিযোগে মেজর পদমর্যাদার একজন সেনাসদস্যকে আটক করেছে সেনাবাহিনী। এ অভিযোগে গত মাসে ভাটারা থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এক মামলায় মেজর সাদেকের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিণসহ আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের ২২ নেতাকর্মীকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ১৬ বছরের দু:শাসন, দুর্নীতি, গুম-খুন, গণহত্যাসহ সীমাহীন লুটপাট ও অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশকে দেউলিয়া করে তোলার জন্য আওয়ামী লীগের কোনো স্তরেই কোনো অনুশোচনা, দুঃখবোধ কিংবা দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের স্বাভাবিক-সাধারণ প্রয়াস দেখা যায়নি। তারা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উপর ভর করে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই আবার মসনদ দখলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে নাশকতামূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অভাবনীয় তা-বে বিস্ময়বিমূঢ় বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আগের মতই সবকিছুই নীরবে মেনে নেয়ার মধ্য দিয়ে দলটিকে রাজনৈতিকভাবে অচ্ছুৎ অকার্যকর করে তুলতে পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করছে। অনেকে শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থেকে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা পালন করছে।
পতিত স্বৈরাচারের দোসর ও অলিগার্কদের বেশিরভাগই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। আবুল বারাকাত, নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ্র মত লোকেরা ফ্যাসিবাদের বয়ান ও ভুয়া নির্বাচনের রেটরিক জনমনে প্রোথিত করে এর ভিত্তি মজবুত করতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর পর এদের গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন না করে একবছর পর এদের দু’একজনকে আটক করা হয়েছে। নিজেরা ঐক্যবদ্ধ না থাকলে দেশে এক-এগারোর মত সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করা হলেও এসব নিয়ে যেন রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশ নেতাকর্মীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! তারা এখন ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য ভেঙ্গে এককভাবে ক্ষমতার মসনদ ভোগদখলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পতিত স্বৈরাচারের ভাষায় কথা বলছেন। তারা ভুলে যাচ্ছেন, তারেক রহমান এখনো দেশে আসতে পারেননি। তারা ভুলে যাচ্ছেন, এখনো জামায়াত গণসংগঠন হয়ে উঠতে পারেনি। বামরা এখনো একাত্তরের ন্যারেটিভ দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম। জুলাই অভ্যুত্থানের বার্ষিকী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর সাম্প্রতিক কর্মকা- থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সমর্থন পেতে বাম-ডানের ছাত্র সংগঠনগুলো রীতিমতো প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। শুধু তাই নয়, তারা আওয়ামী লীগও ছাত্রলীগের যে ন্যারেটিভ ও শ্লোগান প্রত্যাখ্যান করে জুলাই বিপ্লব ঘটিয়েছিল, সেই শ্লোগানকেই নতুন করে শানিত করতে চাইছে। অর্থাৎ পুরনো রাজনৈতিক দুষ্টচক্রে জাতিকে ঘুরপাক খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেয়ার কারসাজিতে পা দিচ্ছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধি আন্দোলনের সহযোগি-সহযাত্রী রাজনৈতিক দলগুলো। এহেন বাস্তবতায় পুরনো ও গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বন্দোবস্তের বাইরে গিয়ে জাতিকে নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নিতে হলে আমাদেরকে সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিএনপি’র মুখপাত্র ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের একটি বক্তব্য খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তিনি বলেছেন, ‘মানসিক সংস্কার ব্যতিরেকে রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার সফল হবে না।’ মানসিক সংস্কার বলতে কি বুঝায় এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে এর মোদ্দা কথা হতে পারে, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, কূপমন্ডুকতা, বিভক্তি বিভাজনের ফ্যাসিবাদি ও আধিপত্যবাদি ন্যারেটিভের বাইরে নতুন সাংস্কৃতিক ভাবধারা গঠনের কথা বলতে চেয়েছেন তিনি। আরেকটু খোলাসা করে বললে, মানসিক সংস্কারের পদ্ধতিগত রাজনৈতিক এজেন্ডার কথা যদি আমরা বলতে চাই, তা হতে পারে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বার্তা। আইন করে কিংবা কোনো একটি বিশেষ ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে কোটি মানুষের মানসিক সংস্কার ও কিংবা বিভ্রান্তিমূলক পুরনো ন্যারেটিভ থেকে জাতিকে বের করে আনা সম্ভব নয়। এর জন্য ঐতিহাসিক সত্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য এবং সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির এজেন্ডা থাকতে হবে। পতিত স্বৈরাচার পালিয়ে যাওয়ার পরও এতদিন ধরে জুলুমের শিকার, আন্দোলনের সহযাত্রী রাজনৈতিক দলগুলো ফ্যাসিস্টের ন্যারেটিভ ব্যবহার করে ক্ষমতার সিঁড়িতে উঠতে চাইছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, এসব ন্যারেটিভ ও শ্লোগান স্বৈরাচারের প্রতি জনসমর্থন ধরে রাখতে না পারলেও দীর্ঘদিনের প্রোপাগান্ডা বিপদে, বাণের জলে খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টার মত এক ধরণের মনস্তাত্তিক প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি’র সামনে কোনো বড় প্রতিপক্ষ নেই। তার প্রতিপক্ষ নিজ দলের পশ্চাদপদ, কূপমন্ডুক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা। জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নেতাকর্মীদের বারবার সাবধান বাণী শোনাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচনে জেতা অতটা সহজ হবে না। বিগত চুয়ান্ন বছর ভোটের রাজনীতিতে পেশিশক্তি, অস্ত্র, অর্থ এবং প্রশাসনিক পক্ষপাত বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে দেখা গেলেও এবার সাড়ে ৪ কোটি নতুন ভোটার গতানুগতিক চিন্তার বাইরে গিয়ে নতুন ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে ভোট দিতে যাবে। আধিপত্যবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অগ্রসর গণতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন চিন্তা ও ভাবধারাই হোক আগামী নির্বাচনে ভোটের জনমতকে প্রভাবিত করার কৌশল ও প্রতিযোগিতার মূল এজেন্ডা।