ইতিহাসের সাক্ষী: ইউক্রেনে ১৯৩০-এর দশকের যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মারা যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ

১৯ মিনিট আগে

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

কিয়েভ শহরে ইউক্রেনীয় কৃষকরা, ১৯৩৪।

১৯৩৩ সালের বসন্তকালে ইউক্রেনে এমন এক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল যাতে মারা গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ।

মারিয়া ভলকোভা সে সময় ছিলেন স্কুলের ছাত্রী। তার শৈশবের স্মৃতির সাথে মিশে আছে সেই ক্ষুধার অভিজ্ঞতা।

"আমার বয়স তখন তিন কি চার, কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি পুরোপুরি সচেতন ছিলাম" - বলছিলেন মারিয়া - "তখন ঘরে খাবার কিছু ছিল না। আমরা ঘরে ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করতাম, 'মা আমাকে কিছু একটা খেতে দিতে পারো?' তখন তিনি বলতেন, তুমি বাইরে গিয়ে চেরি গাছ থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে নিয়ে খাও না।"

এই দুর্ভিক্ষ ছিল মানবসৃষ্ট। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন তখন দেশের গ্রামগুলোর ওপর তার কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী চাপিয়ে দিচ্ছিলেন।

সে ছিল এক বিরাট কর্মসূচি । অতীতকাল থেকে সেখানকার কৃষকরা যেভাবে ব্যক্তি-মালিকানাধীন এবং মুনাফা-সৃষ্টিকারী কৃষিকাজ করে আসছিলেন - তা উচ্ছেদ করা হচ্ছিল। জমি আর গবাদিপশু তখন রাষ্ট্র-পরিচালিত যৌথ খামারের অঙ্গীভূত করে নেয়া হচ্ছিল। কেউ এর বিরোধিতা করলে তা নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছিল।

এতে ইউক্রেনের সমাজে একটা তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা দিল ব্যাপক অনাহার।

মারিয়া বলছিলেন, তারা দেখেছেন গ্রামগুলোর বয়স্ক মানুষরা, বা ছোট ছোট শিশুরা কীভাবে ব্যাগ হাতে নিয়ে খাবারের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করতো।

"আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি কাঁদছিলাম আর মাকে বলছিলাম, 'মা ওই বাচ্চাগুলো আবার খাবার চাইতে এসেছে ।' মা বলতেন, আমি কিভাবে ওদেরকে কিছু দেবো? দেখতে পাচ্ছো না আমরা নিজেরাই না খেয়ে আছি?"

বেলগোরোদে ১৯৩৪ সালে একটি যৌথ খামারের কাছে কৃষকদের একটি ঘোড়া মরে পড়ে আছে, অন্যটিও মৃতপ্রায়।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

বেলগোরোদে ১৯৩৪ সালে একটি যৌথ খামারের কাছে কৃষকদের একটি ঘোড়া মরে পড়ে আছে, অন্যটিও মৃতপ্রায়।

ক্রেমলিন ১৯৩২ সালে শস্যের ফলনের যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল - তা পূরণ হলো না।

কর্তৃপক্ষ তখন কমিউনিস্ট কর্মীদের পাঠিয়ে দিলো খাদ্যশস্য বাজেয়াপ্ত করার জন্য। বাইরের বিশ্ব এ নিয়ে প্রায় কিছুই জানতে পারেনি।

কিন্তু গ্যারেথ জোনস নামে একজন তরুণ ওয়েলশ সাংবাদিক প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি কি হচ্ছে তা খুঁজে বের করবেন। তিনি রুশ ভাষা জানতেন।

নানা কৌশলে তিনি মস্কোর বিদেশী সাংবাদিকদের ওপর আরোপিত কড়া নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে একটা ট্রেন ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষুধাপীড়িত এলাকায় চলে গেলেন। পরে তিনি এক রিপোর্টে লিখেছিলেন দুর্ভিক্ষের এই বিবরণ।

'কোন রুটি নেই, অনেক লোক লোক মারা যাচ্ছে'

"প্রতিটি ছোট ছোট স্টেশনে ট্রেন থামছিল। ওই সময়টাতেই একজন লোক আমার দিকে এগিয়ে এলো কানে কানে জার্মান ভাষায় বললো, ইংল্যান্ডের লোককে জানাও যে আমরা অনাহারে আছি। এর কিছু পরেই ঠিক করলাম, আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়বো।"

"আমি গ্রামগুলোতে ঢুকলাম। কয়েকটা কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছিল সেখানে যাবার পথটার ওপর বরফ জমে ছিল। প্রথম যার সাথে দেখা হলো, তাতেই আমি দুর্যোগের আভাস পেলাম। একজন মহিলা মাথা নিচু করে রেললাইনে পাশ দিয়ে হাঁটছিল। সে বললো - "কোন রুটি নেই। আমরা গত দু'মাস কোন রুটি খাই নি। অনেক লোক এখানে মারা যাচ্ছে।"

"ওই এলাকার শত শত কৃষকের মুখে আমি একই কথা শুনেছি। এটি ছিল মধ্যাঞ্চলীয় ব্ল্যাক আর্থ এলাকা। রাশিয়ার সবচেয়ে উর্বর অঞ্চলগুলোর একটা।"

মস্কো শহরে এক গৃহহীন বালক, ১৯৩৪

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

মস্কো শহরে এক গৃহহীন বালক, ১৯৩৪

"আমি গ্রামের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, রুটি নেই তাহলে আপনারা খাচ্ছেন কি?"

"এতদিন পর্যন্ত আমরা কিছু আলু খাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের যা মজুত ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু গরু-ছাগলের খাবার আছে।"

"সে আমাকে দেখালো তারা কি খাচ্ছে। এটা হচ্ছে একধরনের শক্ত বীট - যা গরুকে খাওয়ানো হয়। কিন্তু এমন অনেক পরিবার আছে যাদের আলু বা বীট - কোনটাই নেই। তারা মারা যাচ্ছে" - তার বিবরণীতে লেখেন গ্যারেথ জোনস।

'মাটিতে গজায় এরকম যে কোনকিছুই খেতাম আমরা'

মারিয়ার মনে আছে যে কিভাবে কয়েক বছর ধরে এই অনাহারের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।

"বাগানে কোন কিছু বোনার মত শক্তি কারো ছিলনা" - বলছিলেন মারিয়া। "সে বছর কোন ফসল হয়নি। সেটা ছিল ১৯৩১ সাল । ছেলেমেয়েরা কি করছে তার দিকে কেউ নজর দেয় নি। আমরা এত ক্ষুধার্ত ছিলাম যে মাটিতে গজায় এমন যে কোন কিছু আমরা খেতাম।"

"আমার মনে আছে আমি একবার একটা আগাছা পেয়েছিলাম । সেটার গোড়াটা আমি খেতে গিয়ে দেখলাম, তা এতই তেতো যে আমার মনে হলো এটা হয়তো বিষাক্ত কিছু হতে পারে। আমার মুখে বাদামী দাগ পড়ে গেল, কিন্তু তারপর ভালো লাগলো। মনে হলো এটা হয়তো আমার জন্য উপকারী কিছু হবে, ওটা খেয়ে আমি খানিকটা জোর পেলাম। তারপরে যা হলো, গ্রামের সব ছেলেমেয়ে এসে ওই আগাছাটা খুঁজতে লাগলো।"

মারিয়া ভলকোভার বাবা এক পর্যায়ে তার বাইসাইকেলটা বিক্রি করে দিয়ে এক বালতি শস্য কিনলেন। কিন্তু সেই রাতেই সোভিয়েত গোপন পুলিশ এসে সেই শস্য বাজেয়াপ্ত করলো। মারিয়ার বাবাকে গ্রেফতার করা হলো। তাকে জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো।

কিয়েভে হলোদোমরে মৃতদের জন্য তৈরি স্মৃতিসৌধ

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

কিয়েভে হলোদোমরে মৃতদের জন্য তৈরি স্মৃতিসৌধ

দুর্ভিক্ষে এক একটি পরিবারের সবাই মারা যাচ্ছিল। ছেলেমেয়েদের বাবা-মাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ছোট বাচ্চা আছে এমন মহিলারা ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজছিল। তারা অনেকে আগাছা খাচ্ছিল।

জোনস তার বর্ণনায় লিখেছেন, তিনি নিজেও আগাছা খেয়েছেন।

"কিছু আগাছার শিকড় আমি নিজেও খেয়ে দেখেছি। দেখতাম বরফের ফাঁক দিয়ে আগের বছর গজানো আগাছার শুকনো ডালপালা বেরিয়ে আছে। একজন বুড়ো চাষী আমাকে থামালো। মাঠের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো - একসময় এই জায়গাটা ছিল খাঁটি সোনা। এখন সব আগাছায় ভরে গেছে। আগে একসময় আমাদের ঘোড়া, গরু, শূকর মুরগী ছিল। এখন আমরা ক্ষুধার জ্বালায় মারা যাচ্ছি। একসময় আমরা সারা দুনিয়ার খাবারের যোগান দিতাম। এখন ওরা সব নিয়ে গেছে। আমাদের আর কিছুই নেই। ওরা আমাদের মেরে ফেলছে।

"যেসব কৃষকদের কুটিরে আমি ছিলাম, সেখানে খেতে দেয়া হতো শুধু খুব ময়লা আর পানসে একটা স‍্যুপ। তাতে থাকতো দু'এক টুকরো আলু। সেই কুটিরের ওপর মৃত্যুভয়ের ছায়া পড়েছিল। কারণ তাদের কাছে আগামী ফসল ওঠার আগে পর্যন্ত চলার মতো আলু অবশিষ্ট ছিল না।"

"আমি দক্ষিণের উদ্দেশে রওনা দিলাম। শুনলাম গ্রামবাসীরা বলছে, এখানে তো অবস্থা খারাপ লোক মারা যাচ্ছে। কিন্তু দক্ষিণের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। তুমি পোলটাভা অঞ্চলে যাও, সেখানে দেখবে শত শত খালি কুঁড়েঘর।"

পরিস্থিতি তখন এতই সঙ্গীন আকার নিয়েছিল যে তখন মানুষ মানুষের মাংস খাচ্ছে - এমন খবরও পাওয়া গিয়েছিল। কিছু কৃষক চেষ্টা করেছিল শহর এলাকায় গিয়ে খাবার সন্ধানের। কিন্তু সেখানেও প্রায় কিছুই ছিল না।

"আমাদের গ্রামে কোন রুটি পাওয়া যাচ্ছিল না তাই আমার মা শহরে গিয়েছিল" - বলছিলেন মারিয়া ভলকোভা - "সেখানে তাকে সারারাত ধরে লাইন দিতে হতো রুটির জন্য। কপাল ভালো থাকলে সে এক টুকরো রুটি পেতো।"

মারিয়া বলছিলেন, "একবার সম্ভবত ১৯৩২ সালের শীতে, মা পুরো এক সপ্তাহের জন্য বাড়ির বাইরে ছিল। সে প্রতি রাতে লাইন দিতো। আর রুটির টুকরোগুলো জমাতো আমাদের জন্য ।"

খারকিভ শহরে গ্যারেথ জোনস দেখেছিলেন খাবারের জন্য মানুষ কত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।

"একটি রুটির দোকানের বাইরে জানালাগুলো বোর্ড দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। শ'খানেক লোক চিৎকার করছিল, 'আমরা রুটি চাই।' দুজন সোভিয়েত পুলিশ লোকজনকে দোকানের সামনে থেকে সরিয়ে দিচ্ছিল। বলছিল, 'রুটি নেই, আজকে কোন রুটি আসবেও না।' লোকজন ক্ষেপে গেল। লাইন ভেঙে তারা পুলিশদের ঘিরে ফেললো। পুলিশ বলছিল, 'রুটি নেই, তোমরা আমাদের দোষ দিও না।'

কিয়েভে হলোদোমরের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

কিয়েভে হলোদোমরের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ

কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী ইউক্রেনের ওই দুর্ভিক্ষে ১ কোটি লোক মারা গিয়েছিল। ইউক্রেনীয়রা এর নাম দিয়েছিল হলোদোমর - যার অর্থ না খাইয়ে মারা। তারা একে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছিল। বলেছিল এটা হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলক গণহত্যা - যাতে ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদকে দমন করা যায়।

তবে অনেকে এর সাথে একমত নন। তারা বলেন সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য অন্যত্রও দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। শুধু ইউক্রেনে নয়।

সবাই দুর্ভিক্ষের শিকার হননি

গ্যারেথ জোনস দেখেছিলেন - ইউক্রেনে সবাই যে দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিল তা নয়।

"খারকিভ স্টেশন থেকে ছাড়া ট্রেনের করিডোরে একটি মেয়েকে দেখলাম সে সুন্দর পোশাক পরা। তার গালে গোলাপি আভা। তার এক হাতে খেলনা। আরেক হাতে এক টুকরো কেক। সে হয়তো কমিউনিস্ট পার্টির কোন সদস্য বা কোন ইঞ্জিনিয়ারের মেয়ে।"

সোভিয়েত সমাজে ১৯৩০এর দশকেও শ্রেণীবিভাগ ছিল। আর সে বিভক্তি ১৯৩১ সালে আরো প্রকট হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে সেই বিভক্তি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে সবচেয়ে নজরে পড়ার মতো দৃশ্য।

গ্যারেথ জোনস এর কিছুদিন পরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগ করেন এবং দুর্ভিক্ষের খবর প্রকাশ করেন।

দুই বছর পর পূর্ব এশিয়ায় এক এ্যাসাইনমেন্টে থাকার সময় গ্যারেথ জোনসকে অপহরণ এবং হত্যা করে চীনা ডাকাতরা।

কিন্তু আজকের ইউক্রেনে জোনসকে দেখা হয় একজন বীর হিসেবে - যিনি ১৯৩৩ সালে ইউক্রেনের চরম দুর্ভোগের কথা পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews