সন্তানের মেধা আবিষ্কার করা এবং তা বিকাশে সহায়তা করা অভিভাবকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

সন্তানের মেধা আবিষ্কার করা এবং তা বিকাশে সহায়তা করা অভিভাবকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

শিশু মানেই অসীম সম্ভাবনার প্রতীক। প্রতিটি শিশুর মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনন্য প্রতিভা, যা সঠিক সময় ও সুযোগ পেলে প্রকাশিত হয়। আমাদের সমাজে এখনও একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে— শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস ক্যাডার হলেই জীবনে সফলতা আসে। এই সংকীর্ণ চিন্তাধারার কারণে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানের প্রকৃত মেধা ও সম্ভাবনাকে বুঝতে ব্যর্থ হন। তারা সন্তানের স্বপ্ন ও আগ্রহকে উপেক্ষা করে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে জোরপূর্বক ঠেলে দেন। ফলস্বরূপ, অনেক শিশু হতাশায় নিমজ্জিত হয়, শিক্ষা ও জীবনের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অথচ, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হয়েও জীবনে সফল হওয়ার হাজারও পথ রয়েছে, যা অভিভাবকদের উপলব্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।

শিশুর মেধা ও এর বৈচিত্র্য

প্রতিটি মানুষের মেধা একরকম নয়। কারও মেধা বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাধারায় প্রকাশ পায়, কারও শিল্প-সংস্কৃতিতে, আবার কেউ প্রযুক্তি বা খেলাধুলায় পারদর্শী। শিশুদের ক্ষেত্রে এই শ্রেণিবিন্যাস বিশেষভাবে প্রযোজ্য। উদাহরণস্বরূপ:

১. একাডেমিক মেধা: যারা পড়াশোনায় দক্ষ এবং বিজ্ঞান, গণিত, ভাষা বা সাহিত্যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তারা সমস্যা সমাধানে যুক্তিবাদী এবং বিশ্লেষণাত্মক চিন্তায় পারদর্শী।

২. সৃজনশীল মেধা: যারা গান, নাচ, ছবি আঁকা, সাহিত্য রচনা বা অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করে। এই শিশুরা কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতায় অনন্য।

৩. প্রযুক্তিগত মেধা: যারা কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং, ইলেকট্রনিক্স বা প্রযুক্তি-সংক্রান্ত কাজে আগ্রহী। এরা প্রায়ই নতুন প্রযুক্তি শিখতে এবং উদ্ভাবনী সমাধান তৈরি করতে উৎসাহী।

৪. খেলাধুলার মেধা: যারা শারীরিক কৌশল, দৌড়, ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার বা অন্যান্য ক্রীড়ায় দক্ষ। এই শিশুরা শারীরিক সমন্বয় এবং দলগত কাজে পারদর্শী।

৫. ব্যবসায়িক বা উদ্ভাবনী মেধা: যারা নতুন চিন্তা করতে, নেতৃত্ব দিতে এবং উদ্যোগী হতে পারে। এরা উদ্যোক্তা মনোভাব নিয়ে ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি করতে আগ্রহী।

৬. সামাজিক ও মানবিক মেধা: যারা মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে, নেতৃত্ব দিতে এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করতে আগ্রহী। এই শিশুরা সহানুভূতিশীল এবং সমাজকল্যাণমুখী।

এই বৈচিত্র্যগুলো বুঝতে না পারলে শিশুরা তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তারা হতাশায় ডুবে যায় এবং জীবনে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়।

অভিভাবকদের প্রচলিত ভুল ও তার প্রভাব

আমাদের সমাজে অনেক অভিভাবক মনে করেন, সন্তান যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে না পারে, তবে তার জীবন ব্যর্থ। এই ধারণা থেকে তারা সন্তানের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেন। এই চাপ শিশুর মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে:

- শিশুর আত্মবিশ্বাস কমে যায়।

- পড়াশোনার প্রতি ভয় বা বিরক্তি জন্ম নেয়।

- সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়।

- হতাশা ও মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করে।

দুঃখজনকভাবে, কিছু শিশু ব্যর্থতার ভয়ে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা আমাদের সমাজে উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কীভাবে শিশুর ইউনিক মেধা খুঁজে বের করবেন?

সন্তানের মেধা আবিষ্কার করা এবং তা বিকাশে সহায়তা করা অভিভাবকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এর জন্য কিছু ধাপে কাজ করা যেতে পারে:

সন্তানের আগ্রহ পর্যবেক্ষণ করুন। শিশু কোন কাজে আনন্দ পায়, কোন বিষয়ে সময়ের খেয়াল হারিয়ে ফেলে বা কোন কার্যক্রমে উৎসাহ দেখায়, তা সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করুন। উদাহরণস্বরূপ, কেউ হয়তো গল্প লিখতে পছন্দ করে, আবার কেউ রোবট তৈরির প্রতি আগ্রহী।

সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিন। ছবি আঁকা, গান গাওয়া, যন্ত্র বাজানো, অভিনয়, প্রোগ্রামিং বা গল্প লেখার মতো কার্যক্রমে শিশুর আগ্রহ থাকলে তাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ ও সম্পদ সরবরাহ করুন।

স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখান। শিশুর ওপর নিজের পছন্দ চাপিয়ে না দিয়ে তাকে নিজের আগ্রহ ও লক্ষ্য নির্ধারণে স্বাধীনতা দিন। এটি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা বাড়ায়।

প্রশংসা করুন ও আত্মবিশ্বাস বাড়ান। শিশুর ছোট ছোট অর্জনকেও গুরুত্ব দিন। তাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করুন এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলুন।

সঠিক দিকনির্দেশনা দিন। শিশু যদি খেলাধুলায় দক্ষ হয়, তবে একজন ভালো প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা করুন। যদি প্রযুক্তিতে আগ্রহী হয়, তবে কোডিং ক্লাস বা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করুন।

সফলতার সংজ্ঞা নতুনভাবে নির্ধারণ করা জরুরি

সফলতা মানে শুধু বড় চাকরি, উচ্চ বেতন বা সমাজে মর্যাদা নয়; সফলতা মানে আত্মতৃপ্তি, আনন্দ এবং নিজের প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ। আজকের বিশ্বে এমন অসংখ্য ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে দক্ষতা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সম্মান, অর্থ এবং স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ:

- একজন শিল্পী, ফ্যাশন ডিজাইনার বা চলচ্চিত্র নির্মাতা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করতে পারেন।

- একজন সফল উদ্যোক্তা নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে হাজারও মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন।

- একজন ক্রীড়াবিদ আন্তর্জাতিক পদক জিতে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনতে পারেন।

- একজন প্রোগ্রামার বা সফটওয়্যার ডেভেলপার বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত অ্যাপ বা প্রযুক্তি তৈরি করে নিজের স্বাক্ষর রাখতে পারেন।

- একজন ইউটিউবার, পডকাস্টার বা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে পারেন।

অভিভাবকদের উচিত সন্তানের প্রতিভা ও আগ্রহের ভিত্তিতে তাদের জন্য উপযুক্ত পথ তৈরি করে দেওয়া, যাতে তারা নিজের পছন্দের ক্ষেত্রে সফল হতে পারে।

অভিভাবকদের মনে রাখা উচিত, প্রতিটি শিশুই একটি সম্ভাবনার বীজ। এই বীজকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে তা একদিন মহীরুহে পরিণত হবে। অভিভাবকদের উচিত সংকীর্ণ চিন্তার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে সন্তানের আগ্রহ ও প্রতিভাকে মূল্যায়ন করা। যে শিশু তার ভালোবাসার কাজে নিজেকে নিমজ্জিত করতে পারে, সে-ই প্রকৃত সফলতা অর্জন করে।

তাই আসুন, আমরা আমাদের সন্তানদের তাদের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে দিই। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও পৃথিবীতে সফল হওয়ার অগণিত সুযোগ রয়েছে— শুধু প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা ও সমর্থন। এই শিশুরাই একদিন আগামী দিনের আলোকবর্তিকা হয়ে পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে তুলবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews