♦ কাগজের ব্যাগ ব্যবহারে সৃষ্টি হতে পারে লাখো উদ্যোক্তা ♦ হতে পারে ব্যাপক কর্মসংস্থান ♦ দেশে পলিথিন কারখানা ছোট বড় প্রায় ৩ হাজার ♦ ঢাকাতেই প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হয় ♦ জনপ্রতি বছরে ব্যাগ তৈরি হচ্ছে ৭০০ ♦ একটি ব্যাগ সর্বোচ্চ ১২ মিনিট ব্যবহারের পরই প্রকৃতিতে ঠাঁই নেয় ♦ পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে লাগে ২০০ থেকে ৪০০ বছর ♦ মাটি, পরিবেশ, খাবারে ঢুকছে প্লাস্টিক ♦ হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য, নগরে বাড়ছে জলাবদ্ধতা
নিষিদ্ধ পলিথিনের সর্বব্যাপ্ত ব্যবহারে বিপন্ন হয়ে পড়েছে দেশের পরিবেশ, প্রতিবেশ। হাটবাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে পলিথিনের শপিং ব্যাগে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও কেনাবেচা চলছে অবাধে। এসব পলিথিন মাটিতে পচে না, কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে ফলন কমে যায়। বাজারে মুদি দোকান থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, শাকসবজি, ডিম, তরকারি, ফল, মিষ্টিসহ যে কোনো বিক্রীত পণ্য ভরে দেওয়া হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগে। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজমির। কমে যাচ্ছে মিঠা পানির মাছের উৎপাদন। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
পলিথিনে ভাসছে বাংলাদেশ : প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয়। এসব পলিথিন ব্যাগের একটা বড় অংশ নদীতে গিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের নদীগুলোর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমেছে। এমনিতেই দেশের প্রায় সব নদনদীতে পলিথিন-প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব রয়েছে। পলিথিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সিটি করপোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা শহর এলাকায়। ফলে শহর এলাকার নদনদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী; বরিশালের কীর্তনখোলা; চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। ফলে নদীর দূষণ তো বটেই, জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণে মাছের জীবনচক্র হুমকির মুখে পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে বৃষ্টি শেষে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার বড় কারণ এ পলিথিন। ড্রেনেজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে পলিথিনের কারণে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোয় মূলত টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না-ওঠা এর জন্য দায়ী। ফলে মাটি, পরিবেশ বিপন্ন হয়ে আমাদের খাবারে ঢুকে পড়েছে প্লাস্টিক, পলিথিন। গরিবের সাশ্রয়ী খাবার লালশাকেও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামসহ বেশ কয়েকটি ভারী ধাতুর উচ্চ মাত্রার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
পরিবেশ ও কৃষিজমির সর্বনাশ : দেশের বাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে। পলিথিন মাটিতে পচে না, এতে কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে ফলন কমে যাচ্ছে। বাজারে মুদি দোকান থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, শাকসবজি, ডিম, তরকারি, ফল, মিষ্টিসহ যে কোনো বিক্রীত পণ্য ভরে দেওয়া হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগে। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজমির। পরিবেশ সংরক্ষণে ২২ বছর আগে ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত-বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এর ব্যত্যয় হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ এ আইন লঙ্ঘন করেই প্রশাসনের নাকের ডগায় বাজারগুলোয় অবলীলায় বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে অবৈধ পলিথিন তৈরির কারখানা রয়েছে কমপক্ষে ৩ হাজার। এর মধ্যে পুরান ঢাকা এবং বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে রয়েছে ৭ শতাধিক কারখানা। এসব কারখানায় দৈনিক ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে লাগে ২০০ থেকে ৪০০ বছর। প্লাস্টিক পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্যারিব্যাগ বা পলিব্যাগ। হিসাবমতে, গড়ে জনপ্রতি বছরে ব্যাগ বানানো হচ্ছে ৭০০টি এবং একটি ব্যাগ গড়ে সর্বোচ্চ ১২ মিনিট ব্যবহারের পরই প্রকৃতিতে স্থান নেয়। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়।প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, সমন্বিত তৎপরতা : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশবিরোধী প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যবহার কমিয়ে আনতে মাঠ পর্যায়ে কঠোর মনিটরিং, সমন্বিত তৎপরতা এবং ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। পাশাপাশি দ্রুতপচনশীল কাগজের ঠোঙা, কাগজ ও চটের ব্যাগের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এটা করা না গেলে পলিথিনের নেটওয়ার্ক ঠেকানো যাবে না। কারণ পলিথিন হচ্ছে সহজপ্রাপ্য ও সাশ্রয়ী উপকরণ। এর আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় (২০০১-২০০৬) তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ বাজারগুলো পলিথিনমুক্ত করেছিলেন। ২২ বছর আগে শুরু করা শাজাহান সিরাজের সে উদ্যোগ অনেক দিন টিকে ছিল সাফল্যের সঙ্গে। তবে পলিথিনমুক্তির দ্বারপ্রান্তে গিয়ে তাঁর সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরও বাজারে তেমন পলিথিন দেখা যায়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুর দিকেও পলিথিন ব্যবসায়ীরা বাজারে ঢুকতে পারেননি। পরে ধীরে ধীরে বিগত সরকারের শিথিল নীতির কারণে পলিথিনে সয়লাব হয়ে ওঠে বাজার। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দায়িত্ব নেওয়ার পর প্লাস্টিক পলিথিন ব্যবহার বন্ধে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১ অক্টোবর থেকে সুপার শপে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইভাবে ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাজারে পলিথিনের ব্যবহার।
কাগজ ও চটের ব্যাগ সহজলভ্য করতে হবে : পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগ ও সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বাজার থেকে তুলে দিতে হলে বিকল্প উৎসগুলো সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিথিননির্ভরতার বড় কারণ তা সাশ্রয়ী, সহজলভ্য। এ সহজলভ্যতা রোধ করতে হলে পলিথিন উৎপাদন কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ঋণের মাধ্যমে স্বল্পপুঁজির ছোট ছোট ব্যাগ উদ্যোক্তা গড়ে তোলায় উদ্যোগ নিতে হবে। সাধারণত পলিথিনের উৎপাদন কারখানায় কোটি কোটি টাকার পুঁজি, কিন্তু জনবল কম। ব্যাগ তৈরির ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হলে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এর মধ্য দিয়ে কাগজের ব্যাগ, চটের ব্যাগ কম মূল্যে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কাগজ ও চটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এর জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে মনোযোগ দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি করা যায়। বাজারে পলিথিনের জোগান বন্ধ হলে এবং কাগজ ও চটের ব্যাগের চাহিদা বাড়লে অনেকেই উদ্যোক্তা হতে এগিয়ে আসবেন।
পরিবেশ সংরক্ষণে যুগান্তকারী সুযোগ : দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে তিন দশক ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তাঁর সামনে এখন দেশ ও জাতির জন্য একটি টেকসই পরিবেশ সৃষ্টির বড় সুযোগ। পরিবেশপ্রেমীরা বলছেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ রোধের মধ্য দিয়ে তিনি সে কাজটিই শুরু করেছেন। পাশাপাশি নদনদীর দূষণ ও দখল রোধেও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। অরাজনৈতিক সরকারের বড় সুবিধা এই, তাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের তুষ্ট করার মতো কোনো ব্যাপার থাকে না। এ প্রেক্ষাপটে পরিবেশ সংরক্ষণে সবচেয়ে বড় অবদান রাখার সুযোগ পাচ্ছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে তিনি পরিবেশ সংরক্ষণের মতো জাতির এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সফল করতে পারেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাসেম পলিথিনের টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। তা ছাড়া জাপানের মতো দীর্ঘস্থায়ী ইকো ব্যাগের ব্যবহার চালু করা যেতে পারে, যেগুলো ধুয়ে ধুয়ে ব্যবহার করা যায় এমন উপাদান (তুলা, পাট ইত্যাদি) দিয়ে তৈরি। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তিন আর (রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকেল) কৌশল অবলম্বন করলে সুফল পাওয়া যাবে।’