মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের একটি পন্থা হলো ঘুষ। ঘুষের সজ্ঞায় বলা হয়েছে- কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্যে যা কিছু প্রদান করা হয় তাকে ঘুষ বা উৎকোচ বলা হয়। কারো মতে, অন্যায়ভাবে কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠা বা বাতিল করার নিমিত্তে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অর্থ বা অন্য কিছু প্রদান করাকে ঘুষ বলে। কেউ কেউ বলেন, ঘুষ হচ্ছে স্বাভাবিক ও বৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থের উপর অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা। ঘুষ কখনো দিতে বাধ্য করা হয়, আবার কখনো নিজ উদ্যোগে দেয়া হয়।
ঘুষের বিধান : ঘুষ বা উৎকোচ আসে হাদিয়া বা উপহারের রূপ ধারণ করে। অথচ ইসলামে হাদিয়া জায়েজ কিন্তু ঘুষ হারাম। হাদিয়া দিয়ে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়, আর ঘুষ দিয়ে ভালোবাসা নষ্ট হয়। হাদিয়ায় আর্থিক কোনো লাভের উদ্দেশ্য থাকে না কিন্তু ঘুষে আর্থিক লাভের আশা থাকে। দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তিকে হাদিয়ার আকারে কোনো কিছু প্রদান করাও ঘুষের পর্যায়ভুক্ত। মহানবী সা: বলেছেন, ‘ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতার প্রতি আল্লাহর লানত।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, তারবিয়াতুল আওলাদ, পৃষ্ঠা-২৫৭) হজরত আবু হুমাইদ সাঈদি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, মহানবী সা: একদিন ইজদ গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে সাদাকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত করে পাঠান। লোকটির নাম ইবনুল-লুতবিয়া। লোকটি কাজ শেষ করার পর ফিরে এসে বলল, এ অংশ আপনাদের আর এ অংশ আমাকে হাদিয়াস্বরূপ দেয়া হয়েছে। কথাগুলো শুনে মহানবী সা: ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। মহান আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠান্তে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তা পালনের জন্য আমি তোমাদের মধ্য থেকে কোনো কোনো লোককে নিয়োজিত করি। অথচ তাদের কেউ কেউ ফিরে এসে বলে- এগুলো আপনাদের, আর এগুলো আমাকে হাদিয়াস্বরূপ দেয়া হয়েছে (এরূপ বলা ঠিক নয়, কারণ) যদি এমনই হতো তাহলে সে তার পিতৃগৃহ কিংবা মাতৃগৃহে বসে থাকেনি কেন? তখন সে দেখতে পেত যে, তাকে হাদিয়া দেয়া হয় কি না। সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার জীবন, এ ক্ষেত্রে কেউ যদি কোনো কিছু গ্রহণ করে, তবে সে তা নিজ ঘাড়ে বহন করে কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হবে। বস্তুটি যদি উট হয়ে থাকে তাহলে সেটি তখন চিৎকার করতে থাকবে, যদি গরু হয়, তাহলে হাম্বা হাম্বা ডাক দিতে থাকবে, আর যদি বকরি হয়, তাহলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকবে। তারপর মহানবী সা: মুনাজাতের উদ্দেশে হস্তদ্বয় এতখানি উঁচু করলেন যে, আমরা তার বগল মোবারকের শুভ্রাংশ দেখতে পেয়েছি। তারপর বললেন, হে আল্লাহ! আমি কি পয়গাম পৌঁছাতে পেরেছি?’ (বুখারি ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘উৎকোচ বিচারের ক্ষেত্রে কুফরি আর মানুষের মধ্যে হারাম কর্ম। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং মানুষের ধন-সম্পদের কিছু অংশ জেনেবুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশে তা বিচারকদের কাছে পেশ করো না।’ (সূরা বাকারা-১৮৮) এ আয়াতে বিচারের রায়কে প্রভাবিত করা এবং প্রশাসকদেরকে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠা থেকে আলাদা করার নিমিত্তে অর্থ প্রদানকে ঘুষ বা উৎকোচ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কারা ঘুষ গ্রহণে অধিক আগ্রহী : ইহুদিদের মধ্যে সুদ ও ঘুষের প্রচলন চেয়ে বেশি। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তারা (ইহুদিরা) মিথ্যা শ্রবণে অধিক আগ্রহী এবং অবৈধ অর্থ (ঘুষ) গ্রহণে অত্যন্ত আসক্ত।’ (সূরা মায়িদা-৪২) আবার অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে নবী! আপনি (আহলে কিতাবদের) অনেককেই দেখবেন দোজখে, সীমালঙ্ঘনে ও অবৈধ সম্পদ (ঘুষ) গ্রহণে তৎপর। তারা যা করে নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট।’ (সূরা মায়িদা-৬২) তাদের থেকে এ ব্যাধি এখন মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
ঘুষের ক্ষতি : ঘুষ এমন মারাত্মক ব্যাধি যা দয়া-মায়া, নীতি-নৈতিকতা, আইন-কানুন, বিধি-বিধান সব কিছু বিনষ্ট করে দেয় এবং জাতীয় উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করে। ঘুষের কারণে যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় না। অযোগ্য ব্যক্তি যোগ্য ব্যক্তির আসনে সমাসীন হয়। দুর্নীতির প্রধান কারণ হচ্ছে ঘুষ। ঘুষ দিয়ে দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যায়। ঘুষ খাওয়া কবিরা গুনাহ। তাওবা করা ছাড়া এ গুনাহ মাফ হবে না।
ঘুষের উৎপত্তি : দক্ষিণ এশিয়ায় বিদেশী শক্তিগুলোর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে ঘুষের উৎপত্তি ঘটে। ব্রিটিশ আমলে ঘুষ প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে। এ আমলে জনগণের কল্যাণের নামে প্রণীত হয় নানাবিধ আইন। ভূমি রাজস্ব আদায়ের উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, বিচারকার্য পরিচালনা ইত্যাদি। আর এসবের সাথে সাথে ইংরেজ শাসকদের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ ঘুষের পথকে সুগম করে।
নিরূপায় হয়ে ঘুষ দিলে তার বিধান : যে ব্যক্তি নিজের কোনো ন্যায্য প্রাপ্য জিনিস বা অধিকার আদায়ের জন্য নিরূপায় হয়ে ঘুষ দেয় এবং কারো জুলুম থেকে বাঁচার জন্য অনন্যোপায় হয়ে ঘুষ দেয়, তবে তার উপর অভিসম্পাত পতিত হবে না। এমন পরিস্থিতিতে ঘুষ দেয়া জায়েজ, তবে না দেয়া উত্তম।
বাঁচার উপায় : ঘুষ থেকে বেঁচে থাকা মুমিনের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। আর এর থেকে বাঁচার কিছু উপায় হলো-
১. পরকালের ভয় : এ পার্থিব জীবন মানুষের প্রকৃত জীবন নয়। মৃত্যুর পর থেকে আসল ও অনন্ত জীবন শুরু হবে। যদি ব্যক্তির মধ্যে পরকালের চিন্তা ও ভয় থাকে, তবে সে কোনো দিন ঘুষের কাছেও যাবে না এবং অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের চিন্তা করবে না।
২. সম্পদের লোভ বর্জন : সম্পদ বৃদ্ধির লোভ ও দুনিয়াপ্রীতি মানুষকে অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং ঘুষ থেকে বাঁচতে হলে অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করার চিন্তা বর্জন করতে হবে।
৩. আল্লাহভীতি : আল্লাহভীতি মানুষকে সর্বপ্রকার পাপাচার থেকে বাঁচাতে পারে। যার হৃদয়ে আল্লাহভীতি রয়েছে সে ঘুষের টাকা নিতে যাবে না। কারণ সে জানে ঘুষ খাওয়া হারাম এবং কবিরা গুনাহ।
৪. সম্পদ অর্জনে ইসলামী নীতি অবলম্বন : সম্পদ অর্জনের অনেক বৈধ পন্থা রয়েছে। যার বৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করবে না। মুমিন সদা বৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করে সুদ, ঘুষ ইত্যাদি থেকে দূরে থাকে।
৫. শাস্তির ব্যবস্থা : ঘুষ খাওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুতরাং ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা উভয়কে সরকারি ও বেসরকারিভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে ঘুষ বন্ধ করা সম্ভব হবে।
৬. গণসচেতনতা : ঘুষ এমন জঘন্য অপরাধ, যা দুর্নীতিকে সম্প্রসারিত করে। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ঘুষের ভয়াবহতা থেকে বাঁচানোর জন্য গণসচেতনতা আবশ্যক। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে যদি জনগণকে ঘুষের কুফল ও ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত করা যায়, তাহলে ঘুষ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
৭. যথাযথ পারিশ্রমিক প্রদান : যারা যেসব কর্মক্ষেত্রে ও দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন তাদেরকে যদি যথাযথ পারিশ্রমিক দেয়া হয়, তবে ঘুষ নামক ব্যাধি থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
৮. স্বজনপ্রীতি পরিহার : স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ মানুষকে মন্দ কাজ করতে বাধ্য করে। ঘুষ নামক মন্দ কাজ থেকে বাঁচার জন্য স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ বর্জন করতে হবে।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী