দেশের প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যখন নিজেদের মধ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়েন, পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেন, তখন প্রশ্ন জাগে—এটা কি আদর্শের সংঘাত, না রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতিফলন? ছবি: এআই
দেশের প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যখন নিজেদের মধ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়েন, পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেন, তখন প্রশ্ন জাগে—এটা কি আদর্শের সংঘাত, না রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতিফলন? ছবি: এআই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়—দেশের প্রাচীনতম, সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং প্রতীকী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একে বলা হয় জাতির বিবেকের বাতিঘর। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মশাল, এখানেই গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি, এখান থেকেই বারবার আওয়াজ উঠেছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন নিজেদের মধ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়েন, পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেন, তখন প্রশ্ন জাগে—এটা কি আদর্শের সংঘাত, না রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতিফলন? তাদের অবস্থান আবেগপ্রবণ, না বিবেকনির্ভর?
এই প্রশ্নগুলো শুধু আজকের নয়, অনেক দিনের, এখন আবার সমাজের গভীর সংকট ও বিভাজনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকরা আমাদের মনে করিয়ে দিলেন নতুন করে। শিক্ষকদের বক্তব্য, মতামত বা প্রতিবাদ হতেই পারে এবং হওয়াও উচিত। কিন্তু তা যদি দলীয় অনুগত্যের আবরণে আসে, রাজনৈতিক চাটুকারিতায় রূপ নেয়, তবে তা শুধু বিতর্কিতই নয়, আত্মবিনাশীও বটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ জন শিক্ষক সম্প্রতি একটি বিবৃতি দিয়েছেন, যেখানে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া ‘মব সন্ত্রাস’ বা গণপিটুনির বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষায়, এ সন্ত্রাস মানুষের জীবন, সম্ভ্রম ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে। তারা সুশাসনের অভাব, আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন। বিশেষত, মবকে ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করায় মব সংস্কৃতি একটি বৈধ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এই বিবৃতি নিঃসন্দেহে এক ধরনের নৈতিক অবস্থান। যখন রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যর্থ হয়, যখন জনরোষ আইনকেও উপেক্ষা করে, যখন বিচার না পেয়ে মানুষ বিচার নিজের হাতে তুলে নেয়—তখন একজন শিক্ষক, একজন চিন্তাশীল নাগরিক, একজন বুদ্ধিজীবীর নৈতিক দায়িত্ব হলো এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া। অতীতে আমরা দেখেছি, কেবল সন্দেহের বশে পিটিয়ে মানুষ মারা হয়েছে, নারীদের বিবস্ত্র করা হয়েছে, শিশুদের নির্যাতন করা হয়েছে—এসব ঘটনা সভ্য সমাজে বরদাশতযোগ্য নয়।
কিন্তু এরপরই পাল্টা বিবৃতিতে সরব হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাদা দল’ নামে পরিচিত বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের একটি অংশ। তারা ওই ৭১ জন শিক্ষককে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’, ‘গণহত্যার হুকুমদাতার পৃষ্ঠপোষক’ আখ্যা দিয়ে শাস্তির দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, এই শিক্ষকরা শেখ হাসিনাকে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করেছেন, ‘গণভবনে গিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন’ ইত্যাদি।
এই বক্তব্য শুধু অশালীন নয়, ভয়ঙ্করও বটে। যদি কোনো শিক্ষক বর্তমান সরকারের কোনো অবস্থানে থাকেন, তাহলেও তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার অক্ষুণ্ন থাকা উচিত। কিন্তু এখানে তাকে ‘শাস্তি’র আওতায় আনার যে দাবি, তা এক ধরনের ফ্যাসিস্ট প্রতিস্পর্ধার ইঙ্গিত দেয়—যা নিজেই ওই শিক্ষকদের যুক্তি ও নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তাদের ভাষা, অভিযোগের ধরন এবং দাবির সুর এমন যে তাতে মুক্তবুদ্ধির চর্চা নয়, বরং প্রতিপক্ষকে চুপ করানোর প্রয়াসই স্পষ্ট। রাজনৈতিক মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু সেটি যদি প্রতিপক্ষের বিবৃতি দেওয়ার অধিকারকে অস্বীকার করে, তাহলে সেটা গঠনমূলক বিতর্ক নয়, বরং ক্ষমতার উল্টো প্রতিচ্ছবি মাত্র।
যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো—একজন শিক্ষক কি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস রাখতে পারেন? অবশ্যই পারেন। শিক্ষকরাও মানুষ, নাগরিক, ভোটার এবং সমাজের অংশ। কিন্তু তারা যদি সরাসরি রাজনৈতিক দলের মিছিলে মঞ্চে অংশ নেন, দলের পক্ষ বা বিপক্ষে এমনভাবে বিবৃতি দেন যেখানে যুক্তির বদলে কুৎসা, দলীয় ভাষ্য ও প্রতিহিংসা মুখ্য হয়ে ওঠে, তখন তাদের ভূমিকা শিক্ষকসুলভ থাকে না, বরং তা রূপ নেয় দলীয় ক্যাডারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একটি পুরোনো ব্যাধি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’-র নামে একদল শিক্ষক আওয়ামী লীগ ঘেঁষা অবস্থানে, আবার ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’-এর নামে অন্য দলটি বিএনপি ঘেঁষা। একদল রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, অন্য দলটি কেবল নিন্দার ভাষা খোঁজে। কেউ কেউ বিরুদ্ধ মতকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলেন, অন্য দল সেটিকে ‘দেশপ্রেমিক’ প্রমাণে ব্যস্ত। অথচ শিক্ষকের ভূমিকা হওয়া উচিত—রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর ঊর্ধ্বে অবস্থান নিয়ে যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ করা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সত্য-বিকৃতি যাচাই করতে শেখানো এবং চেতনাবোধ ও মানবিকতার মানদণ্ড দাঁড় করানো।
বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাংলাদেশের চিন্তার প্রতীক, রাজনৈতিক আন্দোলনের উৎসস্থল এবং তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন নির্মাণের কারখানা। যদি এখানেই শিক্ষকরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন, একটি দল অন্য দলকে রাষ্ট্রদ্রোহী বা ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ হিসেবে আখ্যা দেন, তবে শিক্ষার্থীরা কোন দৃষ্টান্ত দেখবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন রাজনৈতিক দলনির্ভর হয়ে ওঠেন, তখন তাদের পাঠদান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একজন শিক্ষক যদি তার ক্লাসে একপক্ষীয় রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দেন, অথবা বিরোধী মতাবলম্বী ছাত্রকে হেয় করেন, তাহলে তা শুধু শিক্ষাগত নয়, নৈতিক অপরাধও বটে।
এই সঙ্কটে রাষ্ট্রের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে। ‘মব সন্ত্রাস’ যদি সত্যি হয় (যা বাস্তবতা), তাহলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তা নিয়ন্ত্রণ করা, প্রতিরোধ করা এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু রাষ্ট্র যদি নিজেই ‘মব’কে রাজনৈতিক প্রেশার গ্রুপ হিসেবে ব্যবহার করে, কিংবা মৌন সম্মতি দেয়, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য চরম হুমকি। শিক্ষকদের বিবৃতি তখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং রাষ্ট্রের নিস্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
একইভাবে, ‘সাদা দল’ বা অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষধর শিক্ষকদের হুমকি-ধমকির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরবতা বা রাজনৈতিক বিভাজনকে প্রশ্রয় দেওয়াও এক ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা।
দুই পক্ষের এই বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি পড়লে বোঝা যায়, এখানে মূল প্রশ্ন ‘মব সন্ত্রাস’ নয়, বরং কে কোন পক্ষ, কে কোন ‘গোত্রে’ তা প্রাধান্য পেয়েছে। একদল ‘মব’ বললে অন্য দল তাকে ‘আওয়ামীপন্থী’ ধরে নিয়ে আক্রমণ করছে। অথচ বিবেকের দৃষ্টিতে বিষয়টি হওয়া উচিত ছিল—মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড়ানো।
তাই, এখন প্রশ্ন ওঠে—এটা কি বিবেক, না আবেগ? যুক্তি, না প্রতিহিংসা? শিক্ষক, না দলীয় সৈনিক? সময় কি এখন আমাদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে বাধ্য করছে না?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার মানে কেবল সিলেবাস শেষ করা নয়। এটি একটি দায়, একটি প্রতিশ্রুতি—যেখানে একজন শিক্ষক তার ছাত্রদের সামনে নৈতিকতার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। তিনি রাজনৈতিক মত রাখবেন, কিন্তু তা বিশ্লেষণী হবে, যুক্তিপূর্ণ হবে। তিনি প্রশ্ন তুলবেন, কিন্তু তা কাউকে অপমান করে নয়। তিনি প্রতিবাদ করবেন, কিন্তু তা প্রতিশোধমূলক নয়, বরং পরিবর্তনের আশা নিয়ে।
বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ যদি আজ আত্মবিশ্লেষণ না করেন, তাহলে আগামী প্রজন্ম তাদের ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে নয়, বরং ‘দলদাস’ হিসেবে মনে রাখবে। যা হবে ইতিহাসের সামনে এক অপমানজনক চিত্র।
বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতির বয়ান দেখে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে এই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এক সংকটের মুখে। তারা একদিকে চাইলে বিবেকের ভূমিকায় দাঁড়াতে পারেন—যেখানে তারা সমাজের ভুলগুলোর বিরুদ্ধে গলা উঁচিয়ে কথা বলবেন, অন্যদিকে দলীয় বন্দীত্বে নিজেদের বিলীন করে রাখতে পারেন—যা হয়তো সাময়িক সুবিধা এনে দেবে, কিন্তু ইতিহাসের কাঠগড়ায় কলঙ্কময় হবে।
আজ প্রয়োজন খোলামনের শিক্ষক, যিনি ভয়ডরহীন হয়ে ছাত্রদের সামনে সত্য তুলে ধরবেন। রাজনৈতিক মত থাকবে, কিন্তু সেটা যেন শিক্ষার শত্রু না হয়। আজ দরকার এমন শিক্ষকসমাজ, যারা দলীয় বিবৃতি নয়, বরং সামাজিক বিবেকের কণ্ঠস্বর হবেন।
জাতির বিবেক দলভুক্ত হয়ে পড়লে জাতি কি দলছুট হয়ে যায় না?