অভ্যুত্থান পরবর্তী ড. ইউনূস সরকার ১৩টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলেন। তন্মধ্যে ‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন’ একটি। সেখানে ইসলামের নারীনীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হামলা চালানো হয়েছে। প্রথমেই বলা হয়েছে, ‘পিতার পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুত্র-কন্যা সমান অংশ পাবে’। অথচ কুরআনে সূরা নিসা ১১ ও ১২ আয়াতে উত্তরাধিকার বণ্টননীতি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। যেখানে ১১ আয়াতে বলা হয়েছে, পুত্র দুই কন্যার সমান অংশ পাবে। এরপর থেকে পিতা-মাতা, দাদা-দাদীসহ বাকী কারা কত অংশ পাবে, সব ব্যাখ্যা এসেছে পরপর দু’টি আয়াতে। দেড় হাজার বছর ধরে তার চর্চা চলছে এবং মুসলিম উম্মাহ তা ধর্মীয় বিধান রূপে অন্তর থেকে গ্রহণ করেছে।
বিগত সরকারের আমলে ‘প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ নামে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথির ভাষণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ কখনোই কোরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালা ভালোভাবে পড়ে আপনারা বলুন কোথায় কোরআন-সুন্নাহ্র পরিপন্থী কথা আছে’ (২৩ মার্চ ২০১১, ইনকিলাব ১/৭ কলাম)। ফলে সেসময় প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা ইসলামের শত্রুদের কোনো চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। তবে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯-তে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত নারী অধিকার সম্পর্কিত ‘সিডো’ (CEDAW) ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে (১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০) বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে তাতে স্বাক্ষর করে, যা কুরআন ও ইসলামী পরিবার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি ‘নীরব টাইম বোমা’। সকল ইসলামী দল তার প্রতিবাদ করে। ফলে বিগত কোনো সরকারই উক্ত সনদ বাস্তবায়নে সাহসী হয়নি। অথচ, ২০১১ সালের ৭ মার্চ শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা এটি হুবহু অনুমোদন করে।
বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত ‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন’ যে প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পেশ করেছেন, তার প্রায় সবটাই নারীস্বার্থবিরোধী এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী। প্রত্যেক সরকারের আমলে বিদেশের খুদ-কুঁড়ো খাওয়া চিহ্নিত নারীবাদীরা আগে বেড়ে সংস্কার প্রস্তাবে অংশগ্রহণ করে এবং সংস্কার কমিশনের সদস্য হয়। অথচ, তারা এদেশের নারী জাতির লালিত বিশ্বাস ও কর্মের প্রতিনিধিত্ব করে না। জানা যায় যে, ইইউভুক্ত ২৭টি দেশে ও অস্ট্রেলিয়ায় ১৮ বছর বয়সের পর একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সন্তানকে পরিবার থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়। বলা হয়, তোমরা এখন স্বাধীন। পরিবারের কারো সাথে তোমাদের কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকবে না। ঠিক গরুর বাছুর বড় হয়ে গেলে যেমন তার মায়ের সাথে সম্পর্ক থাকে না এবং সব গরু যেমন তার দৃষ্টিতে সমান হয়ে যায়, ঐসব মনুষ্য সন্তানগুলির অবস্থাও সেরূপ হয়ে যায়। এখন তার দৃষ্টিতে মা-খালা, ভাই-বোন বলে কারো সাথে হারাম-হালাল কোনো সম্পর্ক থাকবে না। পশুদের মতো মানুষের নারী-পুরুষ সবাই সমান (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ মানুষ হলো নৈতিক জীব। তার চরিত্রে নৈতিকতাই প্রধান। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের নামে যদি উক্ত নৈতিকতার বাঁধ ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং বিদেশি চাল-চলন আমদানি করা হয়, তাহলে দেশের পরিবার ও সামাজিক কাঠামো বরবাদ হয়ে যাবে, যা রাষ্ট্রকেও বরবাদ করবে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে ১৫ দফা সুপারিশসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার নিকটে পেশ করেছে তার মধ্যে বিশেষভাবে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি আপত্তিকর। যেমন (১) কমিশনে পারিবারিক আইনে পিতৃ সম্পত্তিতে পুরুষ ও নারীদের সমান অংশ দাবি করা হয়েছে, যা কুরআনের সম্পূর্ণ বিরোধী। অথচ, সমানাধিকার দেওয়া হলে পুরুষ কেন নারীর মোহরানা ও পারিবারিক দায়িত্ব নিতে যাবে? কেন তিনি বিধবা বোন ও তার সন্তানদের এবং বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়-দায়িত্ব বহন করবে? এজন্যই তো আল্লাহ বলে দিয়েছেন, ‘পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক’ (নিসা ৪/৩৪)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না, সে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করে না’ (আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩০২৫)। পরিবারের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের উপর নির্ভরশীল। সেই নিরিখেই ইসলামী পরিবার ব্যবস্থা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। এজন্যই তো আমরা দেখতে পাই (ক) জয়পুরহাটের দিনমজুর যুবকটি তার প্যারালাইজ্ড বৃদ্ধা মাকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে মজুর খাটতে যায়। কাজ শেষে আবার তাকে কাঁধে নিয়ে বাসায় ফেরে। সারাদিনের খাটুনির আয় মা ও ছেলে ভাগ করে খায়। ছেলে বলে, মা আমাকে পেটে ধারণ করেছেন। আমাকে শিশুকালে মানুষ করেছেন। আজ আমি বড় হয়েছি। মা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। তাই আমি তাকে বহন করছি। তাছাড়া আমার বড় পাওয়া হলো এই মায়ের পায়ের তলে আমার জান্নাত (নাসাঈ হা/৩১০৪; মিশকাত হা/৪৯৩৯)। (খ) একই অবস্থা প্রফেসর হামীদুর রহমান হাসনাতের, যিনি আইসিওতে আছেন। ছেলেরা প্রত্যেকে তাদের বাপকে সেবা করেন। পায়খানা সাফ করার সময় বাপ খুব সংকোচ বোধ করেন। তখন ছেলেরা বলে আব্বা! আল্লাহ আমাদের জান্নাত লাভের সুযোগ দিয়েছেন। আপনি কেন সেটা নিয়ে মন খারাপ করেন? রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি’ (তিরমিযী হা/১৮৯৯, মিশকাত হা/৪৯২৭; ছহীহাহ হা/৫১৬)। (গ) সিরাজগঞ্জের মধ্য বয়সী ভাইটি তার স্ত্রীকে সপ্তাহে ৩ দিন ডায়ালিসিস করায়। হাসিমুখে বলে, স্ত্রীর সেবার মধ্যেই আমি তৃপ্তি পাই। আল্লাহ তাকে আমার জন্য নির্ধারণ করেছেন। আমি অসুস্থ হলে তো সে-ই আমাকে সেবা করত। এখন সে অসুস্থ। তাই আমি তাকে সেবা করি। এর মাধ্যমেই আমি আল্লাহ্র অনুগ্রহ তালাশ করি। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, যে (মানুষের প্রতি) অনুগ্রহ করে না, সে (আল্লাহ্র) অনুগ্রহ পায় না (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬৭৮)। (ঘ) একজন বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা নারী ছোট দু’টি বাচ্চা নিয়ে পরের বাড়িতে কাজ করে খায়। সারাদিন সে হাসিমুখ বজায় রেখে গৃহকত্রীর মন যোগায়। কিন্তু তার ভিতরের জ্বালা কেউ উপলব্ধি করে কি? কেউ কেউ সরকারের দেওয়া সামান্য বিধবা ভাতা পায়, যা ইউপি চেয়ারম্যান বা দলীয় মাস্লম্যানরা টিপসই দিয়ে উঠিয়ে নেয়। বিধবার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। আদর্শ চেতনা এবং পরকালভীতি ব্যতীত এগুলি থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় আছে কি? নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের নেত্রীরা এর কোনো জওয়াব দিতে পারবেন কি? (ঙ) পঙ্গু মহিলাটি রাস্তার এক ধারে বসে আছে। তার নাবালক ছেলেটি জ্যামে আটকে থাকা আমার প্রাইভেট কারের পাশে এসে কাতর কণ্ঠে ভিক্ষা চাইছে। আমি বিব্রতবোধ করছি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবছি, আমি যদি ১০/২০টি টাকার একটি নোট তাকে দেই, তাহলে হয়ত তা দিয়ে মা-বেটায় ৪টি রুটি কিনে খেয়ে বেঁচে যাবে। হায়! এই মুহূর্তে যদি আমার গাড়ি এক্সিডেণ্টে পড়ে, তাহলে আমি শেষ হয়ে যাব অথবা ঐ পঙ্গু মহিলাটির মতো আমিও পঙ্গু হয়ে যাব। কাল ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি তোমার কাছে হাত পেতেছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। যদি তুমি সেদিন দিতে, তাহলে আমি আজকে তোমাকে দিতাম (মুসলিম হা/২৫৬৯; মিশকাত হা/১৫২৮)। কুরআন ও সুন্নাহ্র এসব অমরবাণী মুসলিম উম্মাহকে প্রতি মুহূর্তে তাড়িত করে। অথচ, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কথিত নেত্রীরা পুরুষদেরকে নারীদের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন, যা আদৌ সম্ভব নয়। বাপ-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী নিয়েই পরিবার। এই সম্পর্ক আদৌ ছিন্ন করার নয় এবং তারা কেউ কারো শত্রু নয়। বরং পরস্পরের সহযোগী। আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক’ (বাক্বারাহ ২/১৮৯)।
(২) বাংলাদেশ এখনও জাতিসংঘের ‘সিডো’ সনদের ধারা-২ ও ১৬/১ (গ) সংরক্ষিত রেখেছে, যেখানে বিয়ে-তালাকসহ পারিবারিক ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতার কথা বলা হয়েছে। সেটা ইসলামী আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কমিশন সরকারের প্রতি উক্ত সংরক্ষণ প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে, যা বিস্ময়কর, যা বিগত সরকারও করেনি। প্রশ্ন উঠে, এই কমিশন কাদের প্রতিনিধি হয়ে এই সুপারিশ করেছে? (ত) সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তিতে পারিবারিক আইনের সব বৈষম্য বিলুপ্ত করা হবে’। অথচ, ইসলামের পারিবারিক আইনে বৈষম্য বা অসমতা বলে কিছুই নেই। বরং আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নারী ও পুরুষের যেসকল হক ও মর্যাদা প্রদান করেছেন, তা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করাই হবে সরকারের প্রধান কর্তব্য। (৪) নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের আরেকটি সুপারিশ হলো, সব ধর্মের জন্য একক পারিবারিক আইন চালু করা। এর অর্থ হচ্ছে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবার প্রচলিত ধর্মীয় আইনকে বাতিল করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ আইন চাপিয়ে দেওয়া, যা নিছক ধর্মত্যাগকে উৎসাহিত করার কৌশল মাত্র। এতে বিশৃংখলা ব্যতীত আর কিছুই হবে না। পক্ষান্তরে ইসলামে সুস্পষ্ট পারিবারিক নীতিমালা রয়েছে, যা পরিবর্তনের অধিকার কারো নেই। (৫) আরেকটি সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘পতিতাবৃত্তিকে বৈধ পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে’, যা পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই। এর দ্বারা দেশে ব্যাভিচার বৈধ হয়ে যাবে। সমাজ গরু-ছাগলে ভরে যাবে, যা স্রেফ হটকারী প্রস্তাব ব্যতীত কিছুই নয়। বরং এটাই বাস্তবতা যে, পতিতারাই বাধ্যগত অবস্থায় সেখানে থাকে এবং যে কোনো সময় তারা সেখান থেকে মুক্তি চায়। তাদের মুক্তি দিয়ে সমাজে পুনর্বাসন করা উচিত। (৬) কমিশনের আরেকটি দাবি হচ্ছে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ বন্ধ করা’। অর্থাৎ স্ত্রীর অমতে জোরপূর্বক যৌনাচারে লিপ্ত হওয়া, যা একটি উদ্ভট দাবি মাত্র। বরং বৈবাহিক জীবনে ধর্ষণ শব্দটিই আপত্তিকর। কেননা সেখানে স্বামী-স্ত্রী দায়িত্বপূর্ণ সম্পর্ক লালন করেন। (৭) আরেকটি সুপারিশে মৃত্যুদ-ের বিধান বাতিলের দাবি করা হয়েছে। অথচ, হত্যার বদলে হত্যার মধ্যেই জীবন নিহিত (বাক্বারাহ ২/১৭৯)। যদি দেশে আইনের মাধ্যমে মৃত্যুদ- দ্রুত কার্যকর হতো, তাহলে নিত্যদিনের খুনোখুনি বন্ধ হয়ে যেত। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি জুলাই’২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রকাশ্য দিনমানে দেড় সহস্রাধিক নিরীহ মানুষকে হতাহতকারীরা পার পেয়ে যাবে? মানবতা বিরোধী অপরাধ আদালতের তাহলে কাজ কী হবে? প্রশ্ন জাগে, ছায়ানট, উদীচী, ঘাদানিক, শাহবাগী, মহিলা পরিষদ, নারীপক্ষ এরা কারা? এককথায় জওয়াব, এরা সবাই একই সূত্রে গাঁথা ইসলামের শত্রুপক্ষ। এদের দেওয়া প্রস্তাব এদেশের জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার বিরোধী। আমরা চাই সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে পুনরায় ঢেলে সাজানো হোক এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হোক।
লেখক: আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ ও প্রফেসর (অব.) আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।