সম্প্রতি বিনিয়োগের সুযোগ অনুসন্ধানে সৌদি আরবের ৩১ সদস্যের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলসহ সৌদি আরবের বিনিয়োগ বিষয়ক মন্ত্রী খালেদ-আল ফালেহের বাংলাদেশ সফর নিঃসন্দেহে তাত্পর্যপূর্ণ। ঢাকায় সফররত সৌদি আরবের বিনিয়োগ উপমন্ত্রী বদর আই আলবদরের সঙ্গে দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা লইয়া দফায় দফায় আলোচনা হইয়াছে। আলোচনা হইয়াছে সৌদি আরবের বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও ব্যবসা সম্প্রসারণের কৌশল লইয়া। সৌদি আরবের কোম্পানিগুলি বাংলাদেশের চেইন হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসন খাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছে।
আমরা স্মরণ করিতে পারি, এই বত্সর ২৩ মে কাতারে হোটেল ওয়ালডর্ফ অ্যাস্তোরিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌদি বিনিয়োগ মন্ত্রী খালিদ এ আল-ফালেহ এবং সৌদি অর্থনীতি ও পরিকল্পনামন্ত্রী ফয়সাল আলিব্রাহিম সৌজন্য সাক্ষাত্ করেন। সেই সময় সৌদি দুই মন্ত্রী জানাইয়াছিলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাহারা কয়েকটি বিষয় দেখিয়া থাকেন। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের ভবিষ্যতের বিষয়ে একটি দেশের স্থিতিশীলতাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়া থাকেন। সৌদি আরবের মন্ত্রীদ্বয় বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ ভালো বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন সেই সময়। তাহারা ইহাও বলিয়াছিলেন, বাংলাদেশের নেতৃত্ব খুবই ভালো, তাহাদের ভিশন ও কমিটমেন্টস খুবই ভালো। অতঃপর সম্প্রতি বিনিয়োগের সুযোগ অনুসন্ধানে সৌদি আরবের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলসহ বিনিয়োগবিষয়ক মন্ত্রীর এই সফর নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণে রাখিতে হইবে, বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের জন্য সৌদি আরব সর্ববৃহত্ গন্তব্যস্থল। সেইখানে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশের কর্মীরা সৌদি আরবের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি রেমিট্যান্স পাঠাইবার মাধ্যমে নিজ দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করিয়া আসিতেছেন। এখন যখন সৌদি প্রতিনিধিদল আমাদের দেশের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভালো অবস্থানের কারণে বিভিন্ন সেক্টরে দেশে বড় বিনিয়োগ করিবার প্রস্তাব দিয়াছে, তখন তাহা আমাদের অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে অনেক বড় সুযোগ।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের আগে সেই দেশের কার্যকর বিনিয়োগ পরিবেশ ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করিয়া থাকেন। আর এই যাচাই-বাছাইয়ের অন্যতম বড় মাধ্যম হইতেছে বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা সহজে ব্যবসা করিবার সূচক। সেইখানে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। দেশে বিদ্যমান শিল্প-কলকারখানার মালিক ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুত্ সরবরাহ ব্যতীত বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নহে। বিশ্ব বাজারে যে তুমুল প্রতিযোগিতা রহিয়াছে, উত্পাদন খরচ বৃদ্ধি পাইলে তাহাতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হইতে হয়। গ্যাস-বিদ্যুত্ ঘনঘন আসা-যাওয়া ও দীর্ঘসময় বিদ্যুত্ না থাকিবার সংকটে কলকারখানা সক্ষমতা অনুযায়ী চালু রাখা অনেক ক্ষেত্রেই অসাধ্যপ্রায়। অথচ নির্দিষ্ট সময়ের পর হইতে উদ্যোক্তার সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধের শিডিউল চালু হইয়া যায়। বিনিয়োগের আরেকটি বড় সমস্যা হইল, প্রশাসনিক জটিলতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি। আনুষ্ঠানিক নিবন্ধনপ্রাপ্তি হইতে শুরু করিয়া ব্যবসা পরিচালনা পর্যন্ত, সকল ক্ষেত্রেই প্রশাসনের দিক হইতে প্রতিটি টেবিলে প্রক্রিয়াগত জটিলতা থাকে। ইতিপূর্বে পরিচালিত একটি জরিপে ৭২ শতাংশ ব্যবসায়ী অদক্ষ সরকারি প্রশাসনকে শীর্ষ সমস্যা হিসাবে দেখিয়াছেন। এই ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বড় সমস্যা হইল, যথাক্রমে দুর্নীতি ও অর্থায়নের পরিবেশ। কাজেই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করিতে হইবে সর্বাগ্রে। বিগত দুই দশকে যাহারা বিনিয়োগ করিয়া বিদ্যুত্ ও জ্বালানিসংকটের কারণে যেই ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হইয়াছেন, তাহাদের অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই চুন খাইয়া মুখ পুড়াইবার মতো। সুতরাং, বিনিয়োগের সুযোগ অনুসন্ধানে সৌদি আরবের ব্যবসায়ীরা যাহাতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা পায়, তাহা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করিতে হইবে। বলা যায়, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নের এখনই সময়। সৌদি বিনিয়োগকারীরা যেন বিফল মনোরথে ফিরিয়া না যান।