ঘটনা ১ : বারো মাস বয়সের একটি শিশু আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হয় শ্বাসকষ্ট নিয়ে। তার বুক থেকে এক ধরনের বাঁশির মতো শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছিল। ইতিহাস নিয়ে জানা যায়, কয়েক দিন পরপর এমন হয়, আর এলাকা থেকে নেবুলাইজ করা হয়। মা আমাদের জানালেন, বাচ্চাকে পাতলা করে সুজি খাওয়ানো হয়, আর বাচ্চা প্রায়ই খেতে গেলে বমি করে।
ঘটনা ২ : আরেকটি ছয় মাসের বাচ্চা ভর্তি হয় তীব্র অপুষ্টি আর নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে। তাকেও জন্মের পর থেকে পাতলা করে কৌটার দুধ খাওয়ানো হতো আর সে ঘন ঘন বমি করত। এবার বমির কিছু অংশ শ্বাসনালিতে ঢুকে গিয়েছিল।
ঘটনা ৪ : চার বয়সের এই শিশুকে মা মাঝে মাঝেই হাসপাতালের বহির্বিভাগ কিংবা চেম্বারে নিয়ে আসেন বমির জন্য। বাচ্চা শুধু বুকের দুধ খায়, ওজন ভালো, বিকাশ স্বাভাবিক। তাকে দুধ খাওয়ানোর কিছু ভঙ্গি শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিছু ওষুধও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বমি কমছে না।
আমাদের খাদ্যনালি এবং পাকস্থলীর সংযোগস্থলে এক ধরনের প্রাকৃতিক আংটার মতো থাকে। এর কাজ খাবার বা পানীয় ওপর থেকে নিচে নামিয়ে আনা আর নিচের খাবার ওপরে ফেরত আসাকে প্রতিরোধ করা। ছোট শিশুদের অনেকের (বড়দেরও হতে পারে) এই সংযোগস্থল আলগা বা ঢিলে হলে পাকস্থলীর খাবার ওপরে উঠে এসে বমি হয়ে যায়। এই বমিকে আমরা রিফ্লাক্স বমি বলি।
এই ধরনের রিফ্লাক্স বমি আমরা প্রায়ই পেয়ে থাকি। জন্মের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয়ে কারও কারও এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত এই সমস্যা থাকে। এই বাচ্চাদের অনেকেই খিটখিটে, শরীর, ঘাড় পেছনের দিকে বাঁকা করে মোচড়ানো, দম আটকে যাওয়া, খাবার দেখলেই কান্নাকাটি ও অনীহা দেখায়। অনেকের ওজন ঠিকমতো বাড়ে না। রিফ্লাক্স বমির জটিলতা হিসেবে শ্বাসনালি আটকে যাওয়ার মতো হয়ে দম বন্ধ হওয়া, বুক থেকে দীর্ঘমেয়াদি শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া, কান পাকা, সাইনাসের প্রদাহ, গলার স্বর ফ্যাসফ্যাসে হতে পারে। বুকের শব্দ প্রায়ই শিশুদের হাঁপানির মতো মনে হয়। আরেকটু বড় বাচ্চারা বুক ব্যথার কথাও বলতে পারে।
বয়স অনুযায়ী রোগের লক্ষণ মিলিয়ে এই রোগ নির্ণয় করা যায়। তবে অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা দেখতে হলে বেরিয়াম খাইয়ে এক্স-রে, খাদ্যনালির পিএইচ নির্ণয়, এমনকি এন্ডোস্কোপি পরীক্ষাও লাগতে পারে।
প্রচলিত বিভিন্ন পাকস্থলীর এসিড কমানোর ওষুধ (পিপিআই বা ফ্যামোটিডিন) বা বমির ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তবে আমরা কিছু নিয়ম মানতে তাগিদ দেই।
বাচ্চাকে খুব পাতলা খাবার (যেমন– সুজি, কৌটার দুধ, গরু বা ছাগলের দুধ, ঘরে তৈরি পাতলা সিরিয়াল) না দিয়ে একটু শক্ত আর ঘন খাবারে (হাতে মাখা ভাত, সবজি ইত্যাদি) অভ্যস্ত করতে হবে।
একবারে বেশি খাবার না দিয়ে, বারে বারে অল্প করে খাবার দিতে হবে।
খাবার নিয়ে খুব জোরাজোরি করা যাবে না।
খাওয়ানোর সময় শরীর এমন অবস্থায় থাকা উচিত যাতে শরীরের উপরের অংশের সঙ্গে পেট চাপ খেয়ে না থাকে। তাই শুইয়ে বা ভাঁজ করে বসিয়ে না খাইয়ে, শরীর উঁচু করে খাড়া অবস্থায় রেখে খাওয়াতে হবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, শিশুদের শুইয়ে খাওয়ালে ঘন ঘন কান পাকা রোগ হয়।
অতিরিক্ত ঝাল, মসলা, লবণযুক্ত খাবার (বিশেষ করে চিপস), কৃত্রিম রংযুক্ত পানীয় (দোকানের জুস), চকলেট পাকস্থলীর এসিড বাড়িয়ে সমস্যা বাড়াতে পারে।
টমেটো, পুদিনা, কোমল পানীয়, কফি রিফ্লাক্স বাড়ায়। এগুলো পরিহার করতে হবে।
ওজন অতিরিক্ত হলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ধোঁয়া, ধূমপান থেকে দূরে থাকতে হবে।
এর পরেও যদি রিফ্লাক্স বমি খুব গুরুতর শারীরিক সমস্যা, ফুসফুসের ক্ষতি সাধন কিংবা ওজন কমাতে থাকে, তখন খাদ্যনালির ছোট একটা অপারেশন করলে সমস্যা ঠিক হয়ে যায়।
[শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা]