ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরপরই উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সামগ্রিক রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের যে দাবি উঠেছিল, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে তা যেন ধামাচাপা পড়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাঁচ দফায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ছাড়াও নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন এবং দ্বিতীয় রিপাবলিকের ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবি থাকলেও কিছু রাজনৈতিক দল শুধু ‘নির্বাচনী সংস্কার’ করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে। বিশেষত বিএনপি যেন জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকে নিছক ‘রেজিম চেঞ্জ’ ধরে নিয়ে বিদ্যমান গণবিরোধী ও শোষণমূলক কাঠামোর বৈপ্লবিক সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন চাইছে। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার মূলোচ্ছেদ না করেই ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন ছাড়াই নির্বাচন নিছক ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া কিছুই দেবে না। বিএনপি যদি জনগণের স্বার্থের রাজনীতি করতে চায়, তাহলে ভেঙে পড়া সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার পুনর্গঠন ও গুণগত সংস্কারের পর নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে অবস্থানই সমীচীন হবে। আর যদি তড়িঘড়ি করে ক্ষমতা গ্রহণই দলটির লক্ষ্য হয়, তাহলে দেশের বর্তমান সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এও বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার অন্যান্য ইস্যু থেকে সরে এসে নির্বাচনে মনোযোগ দিক। আউয়াল কমিশন তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে পারলে বর্তমান সরকার পারবে না কেন? তার মানে, বিএনপি আউয়াল কমিশনের মতো নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা চায়? লুটপাটের সহযোগী ও গণনিপীড়নের হাতিয়ার শাসনতন্ত্র, আমলাতন্ত্রসহ বিদ্যমান ব্যবস্থা অক্ষত রেখেই দেশ শাসনের লাইসেন্স পেতে চায়? অথচ জনগণ গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছে পুরো ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য; শুধু ক্ষমতার হাতবদলের জন্য নয়। জনগণ চায় নিপীড়নকামী রাষ্ট্রযন্ত্রের খোলনলচে পরিবর্তন করতে। কিন্তু এর নাট-বোল্ট অক্ষত রেখে খালি নির্বাচনের দিকেই মনোযোগ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ কঠিন করে তুলবে।
রাজনীতিবিদদের মনে রাখা দরকার, প্রজন্মগত যে রূপান্তর ঘটেছে, তার সঙ্গে রাজনীতিরও গুণগত সংস্কার দরকার। দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে দেশের জনগণ যে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণের রাজনীতি হচ্ছে নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন। তার ভিত্তিতেই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ নানা খাতে ব্যাপক সংস্কার দরকার।
দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীর কাছেও স্পষ্ট নয়, কেন নতুন গঠনতন্ত্র বা সংবিধান দরকার। নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি নাকচ করে তারা বলছেন, নতুন সংবিধানের দরকার নেই। বাহাত্তরের সংবিধানে আনা সংশোধনীগুলো পরিবর্তন করলেই দেশে গণতন্ত্র আসবে। তাদের যুক্তি– এই সংবিধানে নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে স্পষ্টভাবে।
বাস্তবে বাহাত্তরের সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক ও রাজনৈতিক অধিকার যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতার কথা থাকলেও ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি নেই। ব্যক্তি নাগরিকের বদলে সরকার, রাষ্ট্র ও সংসদকেই সার্বভৌমত্বের অধিকারী করা হয়েছে। ফলে সরকার ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষার নামে যখন-তখন আইনি কাঠামোর মধ্যেই মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার পরিপন্থি কালাকানুন প্রণয়ন সম্ভব হয়েছে। সংসদকে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের জোরে সংবিধানের পরিবর্তন, পরিমার্জনের অধিকার দেওয়া হয়েছে, যা প্রয়োগ করে সংসদ নাগরিকের বাকস্বাধীনতা পরিপন্থি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ বহু গণবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছে। এটাই কি প্রমাণ করে না, গণতন্ত্রের নামে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রই আসলে চলে আসছে সাংবিধানিকভাবে?
বাহাত্তরের সংবিধানে পরিবর্তন বা সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য গণভোটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি কেন? যেমন– তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের প্রস্তাবটি যদি গণভোটে দেওয়া হতো, তাহলে আমি নিশ্চিত তা পাস করা যেত না। ফলে আমরা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একতরফা জালিয়াতির নির্বাচন ঠেকাতে পারতাম। সংসদের হাতে এমন সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়ার কারণেই রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক শাসন লঙ্ঘিত হয়েছে।
গণসার্বভৌমত্বের সংবিধান থাকলে সংবিধানের পরিবর্তন, জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন প্রণয়ন এবং বিদেশি শক্তি বা সংস্থার সঙ্গে বড় কোনো চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে গণভোটের শর্ত থাকত। তার ফলে একটা জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার আমরা পেতাম। চলমান সংবিধানে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করা হয় না। এ কারণেই সংবিধান নতুন করে লেখা দরকার।
বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নকালেও জনগণের ভোটে তা পাস করানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি তৎকালীন সংবিধান প্রণেতাগণ। আবার রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মতামত নেওয়া হয়নি। তখন যে সংবিধান সভা গঠিত হয়েছিল, তাতে সদস্য ছিলেন পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক-সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে গৃহীত সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। ফলে ঔপনিবেশিক আমলের আইনকানুন, রাষ্ট্র কাঠামো, ক্ষমতা কাঠামো, পুলিশি নিয়ন্ত্রণ, গণনিপীড়ক আমলাতন্ত্রের অনেকটাই অক্ষত রেখে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এভাবেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের গণআকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাহাত্তরের সংবিধানে আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলশাঁস ব্যক্তির অথবা গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের জন্য কোনো গণতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর প্রস্তাবনাই রাখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার এভাবেই শাসনতান্ত্রিকভাবে প্রথম অস্বীকার করা হয়েছিল। অথচ এখন যারা নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের কথা বলছেন, তাদের বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকারকারী!
১৭৭৬ সালের মার্কিন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মূলকথাই ছিল ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব কায়েমের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের রূপান্তর। ফলে ১৯৭২ সালে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের সময় এই ব্যাপারগুলো খেয়াল না রাখা ঐতিহাসিক ভুল ছিল। উচিত ছিল বাহাত্তরের সংবিধানে ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব কায়েমের জন্যই রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর জন্য গণতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর প্রস্তাবনা রাখা। তা না করে সংসদ বা সরকারকেই সার্বভৌমত্ব দিয়ে জনগণকে ইচ্ছামতো শাসন এবং নিপীড়নের সুযোগ রেখেই সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে এখনও ১৮৬০ সালের পেনাল কোড এবং ১৮৯৮ সালের দণ্ডবিধির মতো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনগুলোর দমনমূলক ধারা বহাল আছে।
এখন যে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে দেশের অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র, ক্ষমতা কাঠামো ও রাষ্ট্র কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে শাসনকাজ চালিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতার পক্ষেই ওকালতি মাত্র। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে পুরোনো অগণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রাখলে জনগণের কোনো লাভ নেই। বরং নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে গণসার্বভৌমত্বের ধারণাকে সাংবিধানিকভাবে রূপান্তর করতে হবে এভাবে যে নতুন গঠনতন্ত্রে নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষাই সরকার ও প্রশাসনের মূল কাজ হবে। নাগরিকের এসব অধিকারের বিরুদ্ধে কোনো আইন করা যাবে না এবং যদি সরকার বা সংসদ বা রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে জনগণের পাল্টা প্রতিরোধ সাংবিধানিকভাবেই ন্যায়সংগত বিবেচিত হবে।
নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে যে নতুন রাষ্ট্র কাঠামো, ক্ষমতার বিন্যাস, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হবে, তার ভিত্তিমূল হবে ব্যক্তির অধিকার রক্ষা ও বিকাশ। তাই রাজনৈতিক সংকট সমাধানে দরকার গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনীতি।
ড. যোবায়ের আল মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি এবং ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়