গত সপ্তাহে এএফসি উইমেন’স এশিয়ান কাপের মূল পর্বে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিয়েছে। জুলাইয়ের ২ তারিখে ইয়াঙ্গুনে মিয়ানমারকে হারানোর পর বাহরাইন-তুর্কমেনিস্তান ম্যাচ ড্র হওয়ায় এই সাফল্য নিশ্চিত হয়। এরপর ৫ জুলাই তুর্কমেনিস্তানকে হারিয়ে গ্রুপ-সি’র চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা মূল পর্বে প্রবেশ করে।
এটা যতটা না ‘সংবাদ’, তার চেয়ে বেশি যেন আবেগ! একজন নারী হিসেবে আমার মনে হলো, আমিও যেন ঋতুপর্ণা, তহুরা, আফঈদা, স্বপ্না, মারিয়া বা মণিকার একজন হয়ে উঠেছি। এই জয় ‘আমিও পারি’-এই ধরনের গর্ববোধ জাগিয়েছে। কিন্তু এই আবেগ, এই গর্ববোধ খুব বেশি সময় থাকল না! কারণ, এই সংবাদের লেজ ধরে আরও কিছু সংবাদ নজরে এলো। সেগুলো কেমন একটু দেখে নেয়া যাক:
ঋতুপর্ণারা গত দুই মাস ধরে পারিশ্রমিক পাননি। এর আগে, দ্বিতীয়বার সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরার পরও একই খবর মিডিয়ায় এসেছিল। তখনও তাদের দুই মাসের বেতন বাকি ছিল। এমনকি, টানা দুইবার সাফ জয়ের পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ঘোষিত দেড় কোটি টাকা পুরস্কার ১০ মাস পেরিয়েও তারা পাননি।
৬ জুলাই মিয়ানমার থেকে ফিরে কোনো বিশ্রাম ছাড়াই ঋতুপর্ণা চাকমা ও মণিকা চাকমা ভুটানের উদ্দেশে রওনা হন। সেখানে তারা ঘরোয়া লিগ পারো এফসি’তে খেলছেন।
এই ঘটনাগুলো একসঙ্গে দেখলে মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। নারী ফুটবলাররা যদি শিরোপা বা বড় জয় না পান, তাহলে কি আমরা তাদের এই সমস্যাগুলো জানতে পারতাম? তাদের বেতন বকেয়ার খবর কি তখনই মিডিয়ায় আসে, যখন তারা সাফ জিতেছেন বা এশিয়ান কাপের মূল পর্বে পৌঁছেছেন? কত মাস বেতন না পেলে তা মূলধারার মিডিয়ার কাছে ‘খবর’ হিসেবে গণ্য হয়?
গত বছর বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেছিলেন, স্পন্সর সংকটের কারণে নারী ফুটবলারদের বেতন নিয়মিত হয় না। এর অর্থ, নারী ফুটবল এখনও জনপ্রিয়তা পায়নি, ফলে এর বাণিজ্যিকীকরণও সম্ভব হয়নি।
মিডিয়া এই খেলাকে জনপ্রিয় করতে কতটা ভূমিকা রেখেছে? ঋতুপর্ণা চাকমাসহ পার্বত্য অঞ্চলের খেলোয়াড়দের দারিদ্র্য ও জীবনসংগ্রামের গল্প কেন মিডিয়ায় আসে না? তহুরা খাতুন বা আফঈদা খন্দকারের খেলায় আসার পেছনের গল্প কেন উপেক্ষিত? পুরুষ ফুটবলার জামাল ভুঁইয়া বা হামজা চৌধুরীকে আমরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে দেখি, কিন্তু পরপর সম্মান এনে দেওয়া নারী ফুটবলারদের কেন এমন সুযোগ দেওয়া হয় না? বর্তমানে নারী ফুটবল দলের স্পন্সর ঢাকা ব্যাংক। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে তাদের বিজ্ঞাপন টিভি ও খবরের কাগজে দেখা যায়, কিন্তু কোনো নারী ফুটবলারকে কেন সেখানে দেখা যায় না?
এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলা নিশ্চিত করে মিয়ানমার থেকে মেয়েরা রাত পৌনে দুইটায় ঢাকায় পৌঁছান। রাত সোয়া তিনটায় হাতিরঝিলে শুরু হয় পূর্ব নির্ধরিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। এরপর ঋতুপর্ণা ও মণিকা বাফুফে ভবনে গিয়ে ঘণ্টাখানেক থেকে ভুটানের ফ্লাইট ধরতে ছোটেন। এই অবিরাম দৌড় শুধু জীবিকার তাগিদে। কিন্তু এই গল্প কেন মিডিয়ায় আসে না? মধ্যরাতে সংবর্ধনার আয়োজন কেন?
এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরতে থাকায় নারী ফুটবলের ইতিহাস জানার আগ্রহ জাগে। ১৯৭৭ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ফুটবল শিক্ষক সাহেব আলীর তত্ত্বাবধানে ২২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ঢাকায় প্রথমবারের মতো মেয়েদের ফুটবলের অনুশীলন শুরু হয়। কিন্তু অর্থাভাবে অল্পদিনেই তা বন্ধ হয়ে যায়।
২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের নারী দল প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশে আসে। তখন অন্য খেলার মেয়েদের অনুরোধ করে দল গঠন করা হয়। যশোরে একটি ম্যাচ হলেও নেত্রকোনায় কট্টরপন্থীদের বাধার মুখে খেলা বন্ধ হয়। হাফপ্যান্ট পরে মেয়েরা মাঠে খেলবে— এই চিত্র তাদের কাছে সহনীয় ছিল না। মিরপুরে গোপনে ও নিরাপত্তার মধ্যে একটি প্রীতি ম্যাচ হয়।
২০০৩ সালে ফিফা ও এএফসির তাগিদে বাফুফে নারী ফুটবলের জন্য অনুদান পায়, কিন্তু ওই অনুদান অন্য খাতে খরচ করে ফেলা হয় বলে জানা যায়। কারণ, গুটিকয়েক কট্টরপন্থীর জন্য নারী ফুটবল শুরু করার সাহসিকতা দেখাতে তারা ভয় পাচ্ছিল। ফিফার হুমকির পর ওই সময়েই বাফুফে তৎকালীন সহ-সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুকে চেয়ারম্যান এবং সাবেক ব্যাডমিন্টন তারকা কামরুন নাহার ডানাকে সম্পাদক করে ১৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয় নারী ফুটবল দল তৈরির জন্য। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে নারী ফুটবলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা কমিটি নারীদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় বিশেষ একটি ভূমিকা পালন করেছিল বলে জানা যায়। ওই কমিটি রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান থেকে খেলোয়াড় খুঁজতে থাকেন। যুক্তি হিসেবে জানান, পার্বত্য অঞ্চলের মেয়েরা বেশি পরিশ্রমী হওয়ায় তাদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
এরপর বাফুফের তত্ত্বাবধানে ২০০৪ সালে আন্তঃজেলা টুর্নামেন্ট আয়োজন করার পরিকল্পনা হয়। এই ঘোষণার পর কট্টরপন্থীরা টুর্নামেন্ট ভণ্ডুল করে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। ওইসময় বেশকিছু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কাছে ঘুরেও কোনো স্পন্সর পাওয়া যায়নি। তাদের ভয় ছিল, কট্টরপন্থীরা আক্রমণ করতে পারে। যাইহোক, পরবর্তীতে বাফুফের অর্থায়নেই ওই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালেও কোনো ধরনের স্পন্সর ছাড়াই বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে আয়োজিত হয় প্রথম আন্তঃজেলা নারী ফুটবল প্রতিযোগিতা।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতকে খেলার আমন্ত্রণ জানালে কট্টরপন্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়। যশোর ও নরসিংদীতে ম্যাচ আয়োজন করার কথা থাকলেও পরে তা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, চট্টগ্রামে ও শফিপুর আনসার একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়। অবশেষে, ২০১০ সালে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত প্রথম সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের জন্য জার্সি, বল, ট্র্যাকস্যুট ও কিট দিয়েছিল আন্তর্জাতিক স্পোর্টস ব্র্যান্ড পুমা। এটাই বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের প্রথম স্পন্সরশিপ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে নারীদের ফুটবলচর্চা শুরু হয় গোপনে, নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে এবং সর্বোপরি বাধ্য হয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জেন্ডার-সংক্রান্ত বেশকিছু প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। ওই সুবাদেই বিষয়সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়া হয়, তত্ত্বের সাথে পরিচয় ঘটে। বাংলাদেশে নারী ফুটবলারদের পারিশ্রমিক নিয়ে লিখতে বসায় নিজের প্রশ্নগুলো, খটকাগুলো বাধ্য করে এর অতীতটা দেখতে, শুরুটা জানতে। আর এই অতীত তথ্যগুলোই আমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ভারতীয় সাহিত্যতাত্ত্বিক ও নারীবাদী সমালোচক গায়ত্রি চক্রবর্তী স্পিভাক তার ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?’-এ ব্যাখ্যা করেন, সমাজ কীভাবে প্রান্তিক নারীদের কণ্ঠস্বর দমন করে। তার মতে, লিঙ্গবৈষম্য, শ্রেণিগত নিপীড়ন, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গোঁড়ামি—এই বিষয়গুলো একত্রে সমাজে এমন এক বাস্তবতা তৈরি করে যেখানে কিছু জনগোষ্ঠী থাকলেও তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। তাদের প্রতিনিধিত্ব করা হয়, কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে নয়। অর্থাৎ প্রান্তিক নারীদের কণ্ঠস্বরকে ক্ষমতাশীল সমাজকাঠামো তাদের মতো করেই উপস্থাপন করে, যার ফলে প্রকৃত কণ্ঠস্বরটা আমরা কখনোই শুনতে পাই না। এই আওয়াজগুলো কখনোই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শোনা যায় না।
অন্যদিকে, ১৯৮০-এর দশকের অস্ট্রেলিয়ান সমাজবিজ্ঞানী ও সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাইউইন কনেলের প্রদত্ত ‘হেজিমোনিক ম্যাসকুলিনিটি’ জেন্ডার অধ্যায়নে বহুল জনপ্রিয় একটা তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, সমাজকে এমন একটা কাঠামো প্রদান করা যেখানে পুরুষত্বের নির্দিষ্ট রূপকে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও কর্তৃত্বের অবস্থানে স্থাপন করা হয়। আর পুরুষত্বের ওই রূপটি নারীত্বকে করে তোলে গৌণ। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, পুরুষত্ব কোনো জন্মগত বা জৈবিক বৈশিষ্ট্য নয়, বরং এটি সামাজিকভাবে নির্মিত এবং ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত ও পরিবর্তনশীল একটি বৈশিষ্ট্য।
এই দুই যুক্তির মধ্যে ফেললে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা কেন নিয়মিত পারিশ্রমিক পান না, কেন সেগুলো মূলধারার মিডিয়ায় আসে না, কেন মূলধারার মিডিয়া তাদের নিয়ে রিপোর্ট করতে আগ্রহ দেখান না, কেন বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা কোনো স্পন্সর পান না, কেন তাদের কোনো বিজ্ঞাপনে দেখা যায় না, কেন তারা কোনো ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে চুক্তিভূক্ত হন না—সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
প্রথমবারের মতো ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী নিয়ে নারী ফুটবলের যাত্রা শুরু করতে গিয়ে ফুটবল সংস্থা বুঝে গিয়েছিল, যে বাংলাদেশের সমাজকাঠামো এটাকে সহজভাবে গ্রহণ করবে না। এজন্য তার পিছু হটেছিল। এরপর যখন বাধ্য হয়ে শুরু করল, তখন তারা পরিকল্পনামাফিকই পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী মেয়েদের অর্ন্তভুক্ত করেছেন। কারণ এই জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই এদেশে অবহেলিত ও বঞ্চিত অবস্থায় জীবনযাপন করছে। ভাষা, ভূমি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। সুতরাং দরিদ্র এই জনগোষ্ঠীর নারীদের সহজেই এখানে অর্ন্তভুক্ত করা যায়। এর মাধ্যমে তারা শুরুতেই এটা নিশ্চিত করেছেন, শোষণ করলেও ওই চিত্র যেন স্পষ্ট না হয়। নারীবাদী সমালোচক স্পিভাকের প্রবন্ধে আমরা এ ধরনের একটা চিত্রই দেখতে পাই।
আবার প্রতিনিয়ত কট্টরপন্থীদের আক্রমণের আশঙ্কায় আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা কমিটি নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত হলেও তারা কট্টরপন্থী মতাদর্শের বাইরে যায়নি। বরং এই ক্ষমতাশীল মতাদর্শের আলোকেই সমাজকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এ কারণে কোনো কোম্পানি নারী ফুটবলারদের স্পন্সর করার সাহস দেখায় না, মূলধারার মিডিয়া তাদের কণ্ঠকে প্রাধান্য দেয় না। এটি একটি পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যমূলক মানদণ্ড, যেখানে শুধু পুরুষদের অবদানকেই কেন্দ্রে রাখা হয়। সমাজবিজ্ঞানী রাইউইন কনেলের তত্ত্বে এই বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যেখানে পুরুষত্বকে সামাজিকভাবে নির্মিত ও প্রাধান্য দেওয়া বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখানো হয়, যা নারীত্বকে গৌণ করে।
এই ক্ষমতাশীল সমাজকাঠামোর বলয় ভাঙা একটি যুদ্ধের সমান। তাই ঋতুপর্ণা, স্বপ্না, কোহাতি, জয়নবদের কেবল খেলার মাঠে নয়, এই কাঠামো ভাঙার লড়াইয়েও অংশ নিতে হবে। তাদের কণ্ঠকে এত উঁচুতে তুলতে হবে যেন তা তাদের অনুপস্থিতিতেও প্রতিধ্বনিত হয়। এই লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে তাদের অস্তিত্ব প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বলিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত।