প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট সংস্করণ
‘মায়ের ডাক’ বিগত আওয়ামী আমলে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত মজলুম মানুষগুলোর একটি প্লাটফর্ম। ২০১৪ সাল থেকে এই সংগঠনটি আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে অপহরণ, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার ভিকটিমদের নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১১ বছর এই সংগঠনটি কাজ করেছে আতংকে, ভয়ে আর নিজেরাই গুম হয়ে যাওয়ার ভয়ে; কেননা তখন ক্ষমতায় ছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে তারা ভিকটিম পরিবারগুলোকে নিয়ে একটি সমাবেশ করে। এ বছর এ সংগঠনটি বড়ো পরিসরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সমাবেশের আয়োজন করে, ভয়হীন ও দুশ্চিন্তামুক্ত পরিবেশে। কারণ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে গেছে ৪ মাস আগেই।
এবার তাদের আয়োজনে যেমন ছিল ব্যাপকতা, তেমনি ভিকটিমদের অংশগ্রহণের মাত্রাও ছিল অনেক বেশি। এই আয়োজনে এমন অনেক কিশোর বা কিশোরী ছিলেন, যারা ২০১৪ সালে নিতান্তই শিশু ছিলেন। তাদের অনেকেই জীবিত কোনো বাবার মুখ দেখেনি। অনেকে এখনো বাবার বা ভাইয়ের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। সারা দেশ থেকে আসা ভিকটিমেরা এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। বিডিআর বিদ্রোহের ভিকটিম, মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের ভিকটিম, হেফাজতে ইসলামের গণহত্যার ভিকটিম, ক্রসফায়ারের ভিকটিম, গুমের ভিকটিম, জুলাই আগস্ট আন্দোলনের শহীদ, পঙ্গু, আহতসহ অনেকেই।
পতিত স্বৈরাচারের পতন হওয়ায় দুটো দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা গেল। আগে যেখানে আয়োজকদের এই অনুষ্ঠান করার কারণে পালিয়ে বেড়াতে হতো, এবার সেখানে মঞ্চেই ছিলেন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা, আরও ছিলেন আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। বলা যায়, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব দলের ও মতের মিলন মেলা ছিল এই আয়োজনটি। আয়োজনে ভিকটিম পরিবার, আহত বা পঙ্গুদের পক্ষ থেকে ঘুরে ফিরে দুটো বক্তব্যই এসেছে। এক: শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে তার বিচার নিশ্চিত করা। তার বিচারের আগে কোনো নির্বাচন নয়। আর দ্বিতীয়ত অধিকাংশ বক্তা রাজনীতিবিদদের সরাসরি ইংগিত দিয়ে বলেছেন, তারা যেন আওয়ামী লীগের সাথে কোনো ধরনের রিকনসিলিয়েশন বা রাজনৈতিক সমঝোতার পথে না আগান। তাদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি যেন আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের সুযোগ না করে দেয়।
এটি সত্য যে, বাংলাদেশ জুলাই-আগস্টের বিপ্লব পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন যে পরিবেশটি অবলোকন করছে তা হুট করে হয়নি। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে অসংখ্য মানুষের ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়ে এই মুক্ত পরিবেশটি এসেছে। এক্ষেত্রে যারা ভুক্তভোগী তাদের বরাবরই আশংকা থাকে যে, জালেমদের দোসররা হয়তো আবার সুবিধাবাদী রূপে দৃশ্যপটে চলে আসবে কিংবা রাজনীতিবিদদের নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে জুলুমতন্ত্রের হয়তো আবার প্রত্যাবতন ঘটবে। এ ধরনের আশংকা তৈরি হওয়ার ঐতিহাসিক বাস্তবতাও রয়েছে। তাই রাজনীতিবিদদেরকেই এ নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং ভিকটিমদের আশ^স্ত করতে হবে যে, এবার অন্তত বাংলাদেশে কোনো মোড়কেই ফ্যাসিবাদ আর ফিরবে না।
আরেকটি বিষয়ও এখানে বিবেচ্য। ফ্যাসিবাদ ফেরা বা না ফেরার বিষয়টি কেবল বাগাড়ম্বরের বিষয় নয়। যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াও অত্যন্ত জরুরি আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে কৌশল হতে পারে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। এই বিষয়টি নিয়েও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত হওয়া ৪ মাসে কিছুটা আশাবাদী হওয়ার মতো দৃশ্যমান কিছু কর্মসূচি চোখে পড়লেও এখনো পর্যন্ত পুরোপুরি আশ^স্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। ফ্যাসিবাদ এবং তাদের দোসররা সামাজিক মাধ্যমে আবার সক্রিয় হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী এখনো উত্তেজক বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন, ফোনালাপ ফাঁস করছেন। অজস্ত্র অপরাধের তথ্য প্রমাণ হাতে থাকার পরও অপরাধীদের আটকের পরিমাণ সে তুলনায় খুবই কম। যাদের ধরা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও মামলায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। যে ধরনের মামলায় তাদেরকে জড়ানো হয়েছে, সেগুলোর পরিণতি নিয়েও জনমনে আস্থার অভাব রয়েছে। এই বাস্তবতায় বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলের ভিকটিমদের মনের চাওয়া ও আকাক্সক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারের সামনের দিনের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।