বইয়ের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক সুপ্রাচীন। দুই মলাটে নারী বন্দি হয়ে আছে হাজার হাজার বছর আগে থেকে। আশ্চর্য মনে হলেও বিশ্বের প্রথম লেখক ছিলেন নারী। নাম এনহেদুয়ান্না। তিনি ছিলেন রাজদুহিতা। পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীন আক্কাড দেশের রাজা প্রথম সারগনের কন্যা তিনি। চাঁদের দেবী নান্নার পূজারি এই রাজকন্যা প্রেম এবং যুদ্ধের দেবী ইনন্নার উদ্দেশে কিছু গীত রচনা করেছিলেন। মাটির ফলকে সেগুলো এখনো উৎকীর্ণ রয়েছে। তলায় রাজকুমারীর স্বাক্ষর। এ ঘটনা খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দের। এশিয়া নিবাসী লেডি মুরাসাকি লিখলেন, ‘গেঞ্জির উপাখ্যান’ বা ‘টেল অব গেঞ্জি’ ১০০১ খ্রিস্টাব্দে। এই দুটি অভূতপূর্ব ব্যতিক্রমী ঘটনার উল্লেখ আছে ১৯৯৬ সালে ভাইকিং। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত আলবর্তো মাঙ্গোয়েল রচিত ‘A History of Reading’ রচিত পুস্তকে। আবার এ দুটি ঘটনাও প্রমাণ করে বইয়ের দুনিয়ায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একচেটিয়া আধিপত্য এবং শাসন কতখানি বিভ্রান্তিকর। বইয়ের সঙ্গে নারী সম্পৃক্ত এবং সন্নিবিষ্ট হয়ে আছে পুরুষের কলম ধরার বহু বছর আগে থেকেই।

চমক আরও আছে। বিশ্বের প্রথম পেশাদার পুস্তক সমালোচকও/ একজন নারী। উনিশ শতকের আমেরিকার মার্কাগেট ফুলার প্রথম দেখালেন পুস্তক সমালোচনার মূল সূত্রটি কী? তাঁর আবেগমথিত রচনা ‘ওম্যান ইন দ্য নাইনটিথ সেঞ্চুরি’ আজও বিবেচিত হয় নারী চেতনার নারীবাদের এক মূল্যবান দলিল হিসেবে। আবার কট্টর নারীবাদী সমালোচনার প্রবক্তা হলেন ভার্জিনিয়া উলফ। তিনি তাঁর A Room Of Ones Own (1929) পুস্তকে দেখালেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কীভাবে নারীকে বাধা দেয় তাঁর উৎপাদনশীল এবং সৃজনশীল সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে। এরপর সিমোন দ্য বেভোয়ার এবং মেরি এলম্যান তাঁদের রচিত পুস্তকে The Thinking About Women (1968) তে নারীবাদী তত্ত্বকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিতর্কিত করে তুলেছিলেন। যদিও সলতে পাকানোর কাজটি হয়েছিল সেই ১৭৯১ সালে যখন প্রথম মেরি ওয়েলস্টোনক্র্যাফটের এ ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উওম্যান’ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বঙ্গনারীর মানস, মনন এবং সৃজনে ঘটেছিল এক অদৃশ্য নবজাগরণ যদিও এর কয়েক বছর আগে ১৮৫৬ সালে মহিলা সাহিত্যিকের লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তবিলাসিনী’ প্রকাশ পেল। লেখিকা কৃষ্ণকামিনী দাসী। মহিলা রচিত প্রথম আত্মচরিত লিখলেন বাসসুন্দরী দেবী (১৮০৯-১৯০০)। তাঁর ‘আমার জীবন, গ্রন্থখানি পাঠ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর উজ্জ্বল সংযোজন হলেন ঠাকুরবাড়ির রবীন্দ্রনাথ-অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২)। ১৮৭৬ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘দীপ নির্ব্বাণ’ দিয়ে শুরু হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস রচনা। ভারতী পত্রিকার এই সম্পাদিকা এবং সখী সমিতির এই প্রতিষ্ঠাতা বিভিন্ন বিষয়ে পুস্তক রচনায় উনিশ শতকে ছিলেন অগ্রগণ্য। এই ব্যতিক্রমী ধারাকে আরও সমৃদ্ধ করেন রবীন্দ্রনাথ-অগ্রজ সত্যেন্দনাথ ঠাকুরের কন্যা এবং ‘সবুজ পত্র’র বিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা-উত্তর বা উত্তর ঔপনিবেশিক ট্র্যাডিশন তৈরি করেছিলেন। ফলত ইনডিভিজুয়াল ট্যালে হিসেবে বিকাশ লাভ করতে পেরেছিলেন আশাপূর্ণা, মহাশ্বেতা দেবীর মতো প্রতিভাময়ী বিখ্যাত লেখিকা। পরবর্তীকালে বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য সেই শতাব্দীপ্রাচীন ধারাটিকে উৎকর্ষ এবং সম্পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে তাঁদের সাদর অভ্যর্থনা ও স্বীকৃতি জানিয়েছে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন উপায়ে।

দুই মলাটের মুদ্রিত অক্ষরে নারী রচনা করে তার অভূতপূর্ব জীবনকাব্য। জন্ম দেয় নতুন ভাষার, প্রতিবাদের লড়াইয়ের। মনে রাখতে হবে, পুরুষ কখনই নারীর শত্রু বা বিরুদ্ধপক্ষীয় নয়, বিরুদ্ধপক্ষীয় হলো পুরুষতন্ত্র। আর এই বিষয়টি ভাঙার প্রচেষ্টায় আমরা দেখতে পাই মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’ গল্পে কত নিখুঁত ও নির্মমভাবে চিত্রিত-দ্রৌপদীর কালো শরীর আরও কাছে আসে। দ্রৌপদী দুর্বোধ্য সেনানায়কের কাছে একবারে দুর্বোধ্য এক অদম্য হাসিতে কাঁপে। হাসতে গিয়ে ওর বিক্ষত ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরে এবং সে রক্ত হাতের চেটোতে মুছে ফেলে দ্রোপদী কুলকুলি দেবার মতো ভীষণ আকাশচেরা তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘কাপড় কি হবে কাপড়? লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? মরদ তু?’  মহাশ্বেতা দেবীর এই দ্রোপদীই হলো প্রকৃত নারী, নির্লজ্জ পুরুষতন্ত্রের সামনে ধারালো অস্ত্রের মতো উন্মুক্ত। এই নারীর জীবনভাষ্যই একটা গোটা আধুনিক মহাকাব্য।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews