ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্ত সৌন্দর্য, আহসান মঞ্জিল। এই প্রাসাদ যেন সময়ের হাত ধরে ইতিহাসের বুকে বুনেছে এক গৌরবময় উপাখ্যান। নবাবদের বিলাসিতা আর জাঁকজমকের প্রতীক এই স্থাপনা গোলাপি রঙের পরশে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।
১৮৫৯ সালে নওয়াব খন্দকার আবদুল গনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বাস্তবিক রূপ নিয়েছিল এই মঞ্জিলে। তার পুত্র আহসানউল্লাহর নামেই প্রাণ পেয়েছিল 'আহসান মঞ্জিল'। এই প্রাসাদ ছিল নবব পরিবারের হৃদয়, যেখানে সুরম্য ভবনের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতো তাদের সুখ-দুঃখের গান।
পটভূমি
আহসান মঞ্জিল হলো ঢাকার নববদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদার সদর কাচারি। সাধারনভাবে নবাববাড়ির রঙমহল তথা গম্বুজবিশিষ্ট দ্বিতল প্রাসাদ ভবনকেই আহসান মঞ্জিল বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এর পশ্চিমে নির্মিত দ্বিতল অন্দরমহলটিও এই প্রাসাদের অংশ হিসেবে বিবেচ্য। আহসান মঞ্জিল এমন একটি ইমারত যার সাথে বাংলাদেশের অনেক ইতিহাস জড়িত। মোটকথা, ঢাকার নবাবদের নানাবিধ জনকল্যাণমূলক কাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই প্রাসাদ ভবন।
অবস্থান এলাকা
ঢাকা মহানগরীর বুড়ীগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে আহসান মঞ্জিলের অবস্থান। এটি ব্রিটিশ ভারতের উপাধিপ্রাপ্ত ঢাকার নবাব পরিবারের বাসভবন ও সদর কাচারি ছিল।
সমগ্র আহসান মঞ্জিল দুটি অংশে বিভক্ত। পূর্ব পাশের গম্বুজযুক্ত অংশকে বলা হয় প্রাসাদ ভবন বা রংমহল। পশ্চিমাংশের আবাসিক প্রকোষ্ঠাদি নিয়ে গঠিত ভবনকে বলা হয় অন্দরমহল। দোতলা এই প্রসাদের মেঝে ও বারান্দা তৈরি করা হয়েছে মার্বেল পাথর দিয়ে। প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে খাবার ঘর, জলসাঘর, দরবার হল, লাইব্রেরি, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর ইত্যাদি।
প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় আছে অতিথিদের থাকার ঘর, বৈঠকখানা, নাচঘরসহ আরো কিছু থাকার ঘর। প্রাসাদের ঠিক সামনে রয়েছে বিশাল বাগানসহ সবুজ মাঠ।
বলা হয়ে থাকে, আহসান মঞ্জিল ঢাকা শহরের প্রথম ইট-পাথরের ভবন। এটি ১৮৫৯ সালে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত হয়। ২৩টি গ্যালারিসহ এই ভবনে প্রায় সাড়ে চার হাজার প্রদর্শনী রয়েছে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য আছে নবাব আমলের ডাইনিং রুম, নওয়াবদের ব্যবহৃত বড় বড় আয়না, আলমারি, সিন্দুক, কাচ ও চিনামাটির থালাবাসন, নবাবদের অতি বিশ্বস্ত হাতির মাথার কঙ্কাল গজদন্তসহ, নবাবি আমলের বিভিন্ন ধরনের অলংকৃত রুপা ও ক্রিস্টালের তৈরি চেয়ার-টেবিল, বিভিন্ন ধরনের তৈলচিত্র, ফুলদানি, আতরদানি, পানদান, নবাবদের ড্রয়িং রুম, নাচঘর, সোনা ও রুপার তারজালিকাজ আহসান মঞ্জিলের মডেল।
জাদুঘর
বর্তমানে আহসান মঞ্জিল একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশ সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এখানে বাংলাদেশ ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের প্রতিনিধিত্বকারী জিনিসপত্র, ছবির সংগ্রহ এবং উপকরণ রয়েছে যা আমাদের দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে জীবন্ত করে তুলে।
জাদুঘরে যাওয়ার জন্য পরিদর্শকদের জন্য বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন প্রদর্শনী, যার মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, পুরানো ঢাকার জীবনের ছবি, এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আলোকচিত্র।
উপসংহার
আহসান মঞ্জিল শুধু একটি ভবন নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের প্রতীক। এখানে দাঁড়ালে মনে হয়, সময় যেন থমকে গেছে, আর আমরা ফিরে গেছি অতীতের সেই রাজকীয় যুগে।
যদি কখনো বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে গোলাপি এই স্বপ্নের কাছে যান, তবে ইতিহাসের এক গভীর পরশ আপনাকে ছুঁয়ে যাবে। আহসান মঞ্জিল তাই শুধু একটি প্রাসাদ নয়, এটি এক জীবন্ত কাব্য, যা বাংলার অতীতকে আজও আমাদের কাছে বাঁচিয়ে রেখেছে। আহসান মঞ্জিলের গঠনশৈলী যেন এক কবিতা। মোঘল ও ইউরোপীয় শিল্পকলার মিশ্রনে তৈরি এর গম্বুজ, প্রশস্ত সিঁড়ি, এবং সুদৃশ্য বারান্দা যেন এক শৈল্পিক প্রতীক। গোলাপি রঙের এই প্রাসাদ তার মাধুর্যে সকল দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করে।
গ্রীষ্মকালীন সময়সূচি : (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) - (শনিবার-বুধবার) সকাল ১০.৩০টা থেকে বিকেল ৫.৩০টা পর্যন্ত। শুক্রবার- বিকেল ৩.০০টা থেকে সন্ধ্যা ৭.৩০টা পর্যন্ত।
শীতকালীন সময়সূচি : (অক্টোবর-মার্চ) - (শনিবার-বুধবার) সকাল ৯.৩০টা থেকে বিকেল ৪.৩০টা পর্যন্ত। শুক্রবার দুপুর ২.৩০টা থেকে সন্ধ্যা ৭.৩০টা পর্যন্ত।
বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন জাদুঘর বন্ধ থাকে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার বাইরে থেকে এলে বাস, ট্রেন, লঞ্চ যেকোনোভাবে আসা যাবে। মহাখালী থেকে আজমীরী, স্কাই লাইন বাস আসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেখান থেকে রিক্সা করে যাওয়া যায়। গাবতলী থেকে ৭ নম্বর, সাভার পরিবহন বাস আসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেখান থেকে রিক্সা করে যাওয়া যায়। সায়েদাবাদ থেকে রিক্সা বা উবার করে যাওয়া যায়। ট্রেনে কমলাপুর নামতে হবে। তবে সেখান থেকে সরাসরি বাস যায় না উবার বা রিক্সা করে যাওয়া যায়। লঞ্চে সদরঘাট টার্মিনালে নেমে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় ১০ মিনিটের পথ।