গত মাসে এইচএসসির ফল প্রকাশ হয়। তাতে যারা জিপিএ ৫ পেয়েছে, তারা সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। কারণ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আসন ছিল প্রায় ৬৪ হাজার। জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার। আর যত শিক্ষার্থী পাস করেছে, সবাইকে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি করানোও কষ্টসাধ্য।
তারপরও সবাই উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে চায়। অথচ কর্মসংস্থান সেভাবে নেই। সে জন্য উচিত হবে শিক্ষাকে বহুমুখী করা। বর্তমান সরকারকে সেই বিষয়ে সংস্কার করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগের জটিলতা নিরসন করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি উপজেলায় একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করতে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে রোবট, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং ইন্টারনেট অব থিংসের মতো প্রযুক্তির সমাজে প্রযুক্তিতে বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে কারিগরি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিতে হবে।
উন্নত দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কারিগরি শিক্ষা। যেমন জার্মানিতে ৭৩, জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ মানুষ কারিগরি শিক্ষায় জড়িত ও দক্ষ। তাই বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষায় ব্যাপক উন্নয়ন হতে হবে। এর ফলে আমাদের দেশে বেকারের সংখ্যা কমে আসবে। তা দেশের টেকসই উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। সবাইকে উচ্চশিক্ষায় না গিয়ে কারিগরি শিক্ষায় পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে, যেন অনেক শিক্ষার্থী এই শিক্ষায় পড়াশোনা করতে আগ্রহী হয়। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়া উচিত বলে মনে করি। আমরা উচ্চশিক্ষার হার বাড়িয়েছি। অথচ ভারত বা শ্রীলঙ্কা থেকে আমাদের কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ সফট স্কিল্ড লোকের সংখ্যা কম। তাই শিল্পপ্রতিষ্ঠান দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে ভুগছে। আমাদের শিক্ষার্থীকে সফট স্কিল বৃদ্ধি করার জন্য শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। তবে এ সংখ্যা প্রশ্নবিদ্ধ। বাস্তবে বেকারের সংখ্যা অনেক। তাই বেকারের সংখ্যা হ্রাস করতে শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার জরুরি।
উচ্চশিক্ষায় উন্নতির জন্য গবেষণায় আর্থিক প্রণোদনা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে শিক্ষকরা বেশি বেশি মানসম্মত গবেষণা করতে আগ্রহী হন। কারণ আমাদের উচ্চশিক্ষায় গবেষণার মান ও গবেষণার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গবেষণার সংখ্যা ও এর মান উন্নয়ন করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বেশি করে নজর দিতে হবে। শুধু নজর দেওয়াই নয়; এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। উচ্চশিক্ষা উন্নয়নের জন্য মূলে কাজ করতে হবে। মূল মানে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার আরও উন্নয়ন হওয়া এবং শিক্ষকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা উচিত। তাহলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করতে আগ্রহী হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক লেভেলে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন এবং পরীক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার করা দরকার। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা না হলে উচ্চশিক্ষায় গলদ থেকেই যাবে। তাই ব্যাপক সংস্কার দরকার।
চিকিৎসা ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করে এখন অনেক শিক্ষার্থী বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে পরীক্ষা দিয়ে থাকে এবং চাকরি করে। কারণ প্রশাসন ক্যাডারকে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তাই সবাই এখন ওই ক্যাডারে যেতে চায়। এ জন্য ক্যাডার বৈষম্য কমাতে হবে। সব পেশা ও ক্যাডারে সুযোগ-সুবিধায় ভারসাম্য আনতে হবে।
শিক্ষক নিয়োগে অনেক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে যোগ্য, দক্ষ এবং মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়া যায়, সে জন্য শিক্ষা কমিশন গঠন করে তাদের দিকনির্দেশনার মাধ্যমে শিক্ষায় উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্যারিয়ার উপযোগী ক্ষেত্র গড়ে তুলতে ও নানামুখী কর্মশালা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণানির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে। চীন বা ভারতের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স সম্পূর্ণভাবে গবেষণাভিত্তিক হতে হবে। ভারতের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মাস্টার্স, এমফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া যেতে পারে। আর স্নাতক বা স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রির জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজে ভর্তির বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
দুঃখের বিষয় হলো, সরকার ১০ বা ১১টি কমিশন করেছে সংস্কারের জন্য। কিন্তু শিক্ষায় সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠন করেনি। বাস্তবে দেশের যে কোনো উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষার উন্নয়ন। তাই শিক্ষার সংস্কারে শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ