সন্ধ্যার অবকাশে স্নিগ্ধ আবহ বিরাজ করে ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে। সেথায় ভেসে বেড়ায় মোহময় গানের সুর। সেই সুরের আশ্রয়ে দৃশ্যমান হয় নাচের নান্দনিকতা। আর এই নাচ-গানের পরিবেশনার নিবেদিত হয় কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। শিল্পিত পথরেখায় দ্র্রোহ, সাম্য ও প্রেমের কবির প্রকাশিত হয় ভালোবাসা। কবির স্বপ্নময় সাম্যের পৃথিবী গড়ার আকাক্সক্ষায় গাওয়া হয় মানবতার জয়গান। এভাবেই সুন্দরের ছবি এঁকে জাতীয় কবির জন্মদিনের আগেরদিন শুক্রবার থেকে শুরু হলো ছায়ানট আয়োজিত নজরুল উৎসব। নাচ-গান, পাঠ, আবৃত্তি  ও কথনে সজ্জিত হয়েছে তিনদিনের এ আয়োজন। রবিবার পর্যন্ত চলমান উৎসবে আমন্ত্রিত ৩০ শিল্পীসহ প্রায় ১৬০ জন শিল্পী উপস্থাপন করবেন বৈচিত্র্যময় নানা পরিবেশনা।

প্রথমদিনের উৎসবে শ্রোতা-দর্শকে পরিপূর্ণ ছিল মিলনায়তন। সেই সুবাদে মুগ্ধতার আবেশে ঝরেছে করতালি। সমবেত নাচ-গানের শুরু হয় এদিনের পরিবেশনা পর্ব। অনেকগুলো কণ্ঠ মিলে  যায় এক স্বরে। সকলে মিলে গেয়ে শোনায়Ñ অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে/প্রদীপ-শিখা সম কাঁপিছে প্রাণ মম...। সুর রসিকের হৃদয় উচাটন করা সেই সুরবাণীর সহযোগে পরিবেশিত হয় বৃন্দ নাচ। এরপর উৎসবের উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতায় স্বাগত বক্তব্য দেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা। আলোচনায় অংশ নেন সংগঠনের সহ-সভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল। নজরুলকে নিবেদিত বিশেষ বক্তৃতা করেন অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল।

নজরুলের প্রতিবাদী চেতনা ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেন বেগম আকতার কামাল। তিনি বলেন, এ দেশে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের নাম একইসঙ্গে পাশাপাশি উচ্চারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ মানুষের ক্ষুদ্র জীবন সীমাকে বাড়িয়ে অসীমের দিকে নিয়ে যান। অন্যদিকে নজরুল সীমাকেই ভেঙে চুরমার করে দেন। তিনি শ্রেণিবৈষম্যকে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। নজরুলের জীবন ছিল পাপ, তাপ, গ্লানি এবং ব্রিটিশ প্রভুদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠার। নিজে প্রতিবাদী হয়ে তিনি প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন। নজরুল ছিলেন প্রতিবাদী ও মানবতাবাদী এক সৃষ্টিশীল কবি। নজরুলের প্রতিভার বিপুল ক্ষমতা ছিল। এ জন্য তিনি এত বিচিত্র কাজ করতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেখানে ধ্রুপদ অঙ্গনের গান করেছেন নজরুল সেখানে হিন্দুস্তানি রাগরাগিণী ব্যবহার করে গান গেয়েছেন। তিনি কোনো ওস্তাদের কাছে গান শেখেননি তিনি। অথচ কত বিচিত্র তার সুর। প্রসঙ্গক্রমে তিনি  বলেন, নজরুলের স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামে শান্তি নিকেতনের আদলে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরির। যেখানে প্রাচ্যদেশীয় শিল্পচর্চা হবে। ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট তেমন একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা চাইব, নজরুলের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হোক। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান যত বেশি প্রতিষ্ঠিত হবে তত বেশি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল অন্তরস্থ ধ্যানে পরিণত হবেন। মানুষ আরও বেশি শিল্পমনা হবে।

খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, ছায়ানট শুরু থেকেই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে সমান গুরুত্ব দিয়ে তাদের সৃষ্টি, শিক্ষা ও চেতনার চর্চা করে আসছে। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের প্রাণের কবি। এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু তিনি কেন আমাদের জাতীয় কবি এ ব্যাপারে অনেকেরই বোঝার মাঝে দ্বিধা আছে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যে ভাবনার ওপর ভিত্তি করে হয়েছে এর সঙ্গে নজরুলের জীবনদর্শন একেবারে মিলে যায়। এ কারণেই তিনি আমাদের জাতীয় কবি। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। নজরুলের সৃষ্টিতে এই চেতনা যেভাবে এসেছে তা আমরা চিরদিন মনে রাখব।

লাইসা আহমদ লিসা বলেন,  সৃষ্টিশীলতার বিপুল ঐশ্বর্যে নজরুল ইসলাম আমাদের মধ্যে বর্তমান হয়ে উপস্থিত থাকেন। তাইতো আমাদের প্রয়োজনেই সৃষ্টির ঐশ্বর্যে তিনি বারবার ফিরে ফিরে আসেন। তার প্রেরণাতেই আমরা শিকল পরে শিকলকে বিকল করি, বাঁধন পরেই বাঁধন-ভয়কে জয় করি, আপনি মরে বরাভয়কে বরণ করি। আসুন নজরুল উৎসবে মানবতার জয়গান গেয়ে উঠি সকলে।

কথন শেষে পরিবেশিত হয় নজরুল সৃষ্ট ‘নবরাগ মালিকা’ নির্ভর গীতি নৃত্যালেখ্য। নাচ-গান ও পাঠে সাজানো হৃদয়গ্রাহী পরিবেশনাটির গ্রন্থনায় ছিলেন খায়রুল আনাম শাকিল। ত্রপা মজুমদারের পাঠের মাধ্যমে এ পর্বের সূচনা হয়। পরবর্তীতে নাচ ও গান পরিবেশনার মাঝে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে খ্যাতিমান এই অভিনয় ও বাচিকশিল্পীর কণ্ঠস্বরটি। প্রথম পাঠের পর ‘রুম ঝুম রুম ঝুম কে বাজায়’ গানের সুরে নাচ করে ছোটদের দল। জান্নাত-এ-ফেরদৌসী লাকী গেয়ে শোনান ‘বন-কুন্তল এলায়ে বন’ শীর্ষক সংগীত। বিজন চন্দ্র মিস্ত্রীর গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল ‘দোলনচাঁপা বনে দোলে’। ঐশ্বর্য সমদ্দার গেয়েছেন ‘হাসে আকাশে শুকতারা’। পরিতোষ কুমার ম-ল পরিবেশন করেন ‘ফিরিয়া যদি সে আসে’। ‘পায়েলা বোলে রিনিঝিনি’ গানকে উপজীব্য করে উপস্থাপিত হয়েছে ছোটদের সমবেত নৃত্যগীত।  মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া গেয়েছেন ‘সতী-হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে’। গীতি নৃত্যালেখাটির পরিবেশনা শেষে সমুদ্র শুভ্রম শুনিয়েছেন  ‘প্রথম প্রদীপ জ্বালো’ শিরোনামের গান। এছাড়া একক সংগীত পরিবেশন করেন ফেরদৌস আরা, প্রিয়ন্ত দেব, আশা সরকার, ছন্দা চক্রবর্তী, শুক্লা পাল সেতু, লাইসা বিনতে কামাল, শর্মিষ্ঠ দাশ ও রেজাউল করিম।

‘নদীর নাম সই অঞ্জনা’ শিরোনামের সমবেত সংগীত পরিবেশন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা। শারমিন সাথী ইসলামের গাওয়া ‘মধুর নূপুর রুমুঝুমু বাজে’ গানের সুরে একক নৃত্য পরিবেশন করেন সামিনা হোসেন প্রেমা। নজরুল রচিত ‘প্রবর্তকের ঘুরচাকায়’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন নাজমুল হাসান। ‘ওঠ রে চাষী’ শিরোনামের কবিতা আবৃত্তি করেন হাসিব বিল্লাহ।

আজ শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এ দিনের আয়োজন শুরু হবে সন্ধ্যা সাতটায়। পরিবেশনা পর্বে থাকবে ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুন গ্রন্থিত গীতি-আলেখ্য ‘সজল শ্যাম ঘন দেয়া’।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews