আন্তর্জাতিক

পশ্চিমা অমনোযোগ গাজা গণহত্যা গুরুতর করে তুলছে

গাজা ভূখণ্ডের উপকূলীয় এলাকাটি মানুষে গিজগিজ করলেও এর আল-মাওয়াসি এলাকা মনোরম এক জায়গা। খান ইউনিস ও রাফার মধ্যে প্রায় ১২ কিলোমিটার (৭ দশমিক ৫ মাইল) বিস্তৃত এ এলাকা চমৎকার সমুদ্রসৈকতগুলোর একটি, যেখানে ঘূর্ণায়মান সোনার বালির টিলা রয়েছে। মনোমুগ্ধকর চার পাশ, শ্বাসরুদ্ধকর সূর্যাস্ত ও শান্ত সমুদ্রের বাতাস একে পরিবার নিয়ে বেড়ানোর জন্য একটি জনপ্রিয় স্থানে পরিণত করেছে। 

কিন্তু সৌম্য-শান্ত সমুদ্রসৈকত আল-মাওয়াসির অস্তিত্ব আর নেই। ইসরায়েলি গণহত্যা একে বিনোদনের স্থান থেকে ভয়াবহ আতঙ্কের একটি জায়গায় রূপান্তরিত করেছে। অক্টোবরের শেষদিকে ইসরায়েলি বিমান যখন গাজা উপত্যকাজুড়ে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছিল তখন দখলদার বাহিনী আল-মাওয়াসিকে ‘একটি নিরাপদ এলাকা’ বলে চিহ্নিত করেছিল। ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে পালিয়ে এসে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকরা এখানে নিরাপত্তা খুঁজত। পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলি সামরিক নেতারা এমনও দাবি করেছিলেন, এটিকে ‘স্থায়ী নিরাপদ অঞ্চল’ বলে তারা বিবেচনা করছেন। 

আল-মাওয়াসিতে কোনো অবকাঠামো ছিল না বললেই চলে। তাই মানবিক সহায়তা দানকারী সংস্থাগুলো সতর্ক করেছিল, এটি বাস্তুচ্যুত শিবিরের জন্য উপযুক্ত জায়গা নয়। তারপরও গাজা শহর, খান ইউনিস, আমার নিজের শহর, পরে রাফা থেকে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি চারদিকে নিরাশ হয়ে সেখানে আশ্রয় লাভের আশায় দৌড়ে গিয়েছিল। অনেকে প্লাস্টিক বা কম্বলের চাদর দিয়ে নিজেদের মতো করে আশ্রয়স্থল বানিয়ে নেয়, যদিও তারা এসব তাদের পরিবারের মর্যাদা সুরক্ষার জন্য একেবারেই কার্যকর ছিল না। তাঁবুতে বাস করা অত্যন্ত দুর্বিষহ। অনাহার, রোগ ও সীমাহীন ক্ষুধা সেখানকার মানুষের জীবনকে জর্জরিত করেছিল। 

শিগগির এটি স্পষ্ট হয়ে গেল, ‘স্থায়ী নিরাপদ অঞ্চল’ মোটেও নিরাপদ নয়। ফেব্রুয়ারিতে আইওএফ বা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ডক্টরস উইদাউট বর্ডারের (এমএসএফ) কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের থাকার জন্য একটি নিরাপদ বাড়িসহ আল-মাওয়াসিতে হামলা চালায়। এতে নারী, শিশুসহ দু’জন নিহত এবং ছয়জন আহত হন। মে মাসের শেষদিকে আইওএফ আবার ওই এলাকায় বোমা হামলা করে ১২ জন নারীসহ কমপক্ষে ২১ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রাফাতে ইসরায়েলকে তার গণহত্যামূলক হামলা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার কয়েক দিন পর এ আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।

২১ জুন আইওএফ আল-মাওয়াসিতে আবার হামলা চালায়। এতে অন্তত ২৫ ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং ৫০ জন আহত হন। এগুলো আইওএফের একের পর এক আক্রমণের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। পশ্চিমা মিডিয়া এগুলোতে খুব কমই মনোযোগ দিয়েছে এবং ইসরায়েলিদের অস্বীকারের পর সামান্যই তুলে ধরেছে। ২৭ জুন আমি আমার পরিবারের একজন চিকিৎসকের বার্তা পেয়ে জেগে উঠি। আল-মাওয়াসির ওপর আরেকটি হামলার বর্ণনা পড়ে আমার হৃদয় কেঁপে উঠল। এবার আইওএফ আল-শাকুশ ও আঞ্চলিক পার্ক এলাকাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল। 

‘এই এলাকাগুলো বাস্তুচ্যুত মানুষ, তাঁবুর ছাউনি, বাড়ির সম্মুখভাগে তাঁবু ও অস্থায়ী আশ্রয়ে ভরপুর। লোকজন একে অপরের ওপর কোনোমতে দিন পার করছে।’ আমার পরিবারের এক সদস্যের পাঠানো এই খুদে বার্তাটি পড়লাম। ‘ট্যাঙ্কগুলো কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই কয়েকটি তাঁবুর ওপর দিয়ে ঢুকে পড়ল এবং নির্বিচারে গুলি চালাল। দেখলাম, মানুষ ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে হুড়মুড় করে পালাতে থাকল; কেউ কেউ স্রেফ জীবন বাঁচাতে দৌড়। 

‘অনেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনে কিছুটা দূরে মাটিতে শুয়ে পড়েছে। অন্যরা যেখানে পেরেছে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে, কেউ কেউ বসেছিল রাস্তায়। মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক সীমাহীন দুঃস্বপ্নের অবসানে কাতরাতে কাতরাতে অপেক্ষা করছিল। ‘আজ আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম এবং সেখানে বিপুল সংখ্যক আহত লোক দেখেছি।’

এ ধরনের আরও বিবরণ দীর্ঘ বার্তায় ছিল। ‘জায়গায় জায়গায় মানুষের পিছু তাড়া করা, নিপীড়ন ও তাদের হত্যা করার এই অব্যাহত প্রক্রিয়া যেন দানবেরা শিকারের নেশায় মত্ত। এগুলো আমার বোধগম্যের বাইরে।’ পরদিন আমি অন্য একজন চিকিৎসকের সাক্ষ্য শুনেছি, যিনি আল-শাকুশে যা ঘটেছে তাও প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
আতঙ্কে লোকজন তাদের জিনিসপত্র, এমনকি তাদের সন্তানদেরও ফেলে রেখে দৌড় দিয়েছিল। ভয়ে তারা দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল এবং পরে ফিরে এসেছিল। দৌড়ে পালানোর সময় এই চিকিৎসক লোকজনের মৃত ও আহতদের গাধার গাড়িতে তুলে নিতে সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু তিনি কোনো চিকিৎসা সহায়তা দিতে পারেননি। অন্যদের মতো তিনি নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন। তারা যে জায়গা নিরাপদ মনে করেছিল, সেখানে পৌঁছানোর পরপরই তাঁর স্ত্রী আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। 

জাতিসংঘ জানিয়েছে, আল-মাওয়াসির ওপর ইসরায়েলের নতুন হামলায় ‘অগণিত হতাহত’ ও অন্তত ৫ হাজার মানুষ ভিটে হারিয়েছে। মেডিকেল সূত্রমতে, অন্তত ১১ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হয়েছেন।

এই বিশাল উদ্বাস্তুর ঘটনা গত ৯ মাস আগের অগণিত মানুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। লোকেরা আল-মাওয়াসিতে ভিড় করে, যেখানে এখনও ইসরায়েলিরা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে অনেকে আল-মাওয়াসিতে ফিরে আসছিল, যা খান ইউনিসে কয়েক সপ্তাহ আগে রাফা থেকে পালিয়ে আসা অসংখ্য মানুষের বাড়ির ধ্বংসাবশেষের শেষ আশ্রয়স্থল। খান ইউনিসে ফিরে আসা নিরাপদ– স্বয়ং আইওএফ এমন দাবি করেছিল। তারা বলেছিল, রাফা বাসিন্দাদের খান ইউনিসে ও আল-মাওয়াসিতে ফিরে আসা নিরাপদ। অথচ তারাই সেখানে পরবর্তীকালে হামলা চালিয়েছে।

ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করে, আইওএফের লক্ষ্য ‘আল-বাশার ওয়া আল-হাজার ওয়া আল-শাজার’ তথা মানুষ, পাথর ও গাছগাছালিসহ সবকিছুই ধ্বংস করে দেওয়া। গণহত্যার এই ৯ মাসের মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে– এই আগ্রাসন ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে নয়, যা হামাস নামেও পরিচিত। এটি পুরোপুরিভাবে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়ার আক্রমণ।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরাও একই সিদ্ধান্তে এসেছেন। জানুয়ারিতে ইসরায়েলের গণহত্যা মামলার শুনানির সময় দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবী আদিলা হাসিম আইসিজেকে বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড ফিলিস্তিনিদের জীবন ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়।’

পশ্চিমা বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা ও জটিলতা, এই অপরাধের সঠিক তদন্তের অভাব, আর পরিকল্পিতভাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বিলম্বিত করার ঘটনা মূলত জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার বিষয়ে তাদের গুরুতর অবহেলাকে তুলে ধরে। ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের জীবনকে লক্ষ্যবস্তু করা শুধু আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন নয়, বরং মানবিক নীতি ও মর্যাদার মৌল ভিত্তির ওপর আক্রমণ।

ঘাদা আজিল: আলবার্টা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ভিজিটিং অধ্যাপক; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর

ইফতেখারুল ইসলাম



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews