একটি বিপ্লব কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। প্রথমত, গণসংহতিকরণের একটি প্রকৃত রূপ, যাতে জনগণের অরূপান্তরিত, সংগঠক শক্তি সরাসরি জড়িত থাকে। দ্বিতীয়ত, সাময়িকভাবে, বিপ্লবগুলো আকস্মিক, তীক্ষ্ণ বা অন্তত তুলনামূলকভাবে দ্রুত রূপান্তর নিয়ে আসে। তৃতীয়ত, রূপান্তরের বিবেচনায়, সাধারণত বিপ্লব সংস্কারের পরিবর্তে আমূল বা মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করে এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক শাসনের অপসারণ ঘটায়। সাধারণত বিপ্লবে আইনবহির্ভূত বা অসাধারণ পদ্ধতি বা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয় (উদাহরণস্বরূপ, ‘উৎখাত’)। বিপ্লব নির্বাচন, আইনানুগ উত্তরাধিকার এবং সংবিধান সংশোধনের মতো আইনি বা সাধারণ পদ্ধতি থেকে আলাদা। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলনে সব উপাদান উপস্থিত ছিল। ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন ছিল একটি গণসংহতি, যা একটি অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে আওয়ামী শাসনকে উৎখাত করে আমূল পরিবর্তন এনেছিল। তাই এটি একটি বিপ্লব, সন্দেহ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব : সফল বিপ্লবগুলো সাধারণত শেষ হয় এমন একটি সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে যা বিপ্লবী নীতিগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় এবং নতুন শাসনে স্থিতিশীলতা এবং জনগণের বৈধতা নিয়ে আসে। এ সমাপ্তি দুই পদক্ষেপ প্রক্রিয়া দিয়ে শুরু হয়। প্রথমে একটি অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থা যার প্রাথমিক দায়িত্ব হলো, সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া সংগঠন ও তা তত্ত্বাবধান এবং তারপর এই পরবর্তী প্রক্রিয়া দ্বারা গঠিত স্থায়ী শাসনব্যবস্থা। এ ধরনের সব সাংবিধানিক বিপ্লবের উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে আমেরিকান, ভারতীয়, দক্ষিণ আফ্রিকান এবং তিউনিসিয়ান। অতএব বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো- ‘সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া সংগঠিত করা এবং তত্ত্বাবধান করা’ এবং তারপর ‘এই সংবিধানের ভিত্তিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা।’ একটি বিপ্লবী সংবিধান প্রণয়ন ছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য সব কর্মকাণ্ড একসময়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
বাংলাদেশে কেন একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন জরুরি?
বাংলাদেশে ২০২৪-এর বিপ্লবকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং সফলভাবে উপসংহারে আনতে একটি নতুন সংবিধান আবশ্যক। বাংলাদেশের বিপ্লব ভেনেজুয়েলা বা বলিভিয়ার মতো ছিল না, ভেনেজুয়েলা বা বলিভিয়ায় এটি নির্বাচনিভাবে সফল বিপ্লবী আন্দোলন ছিল, যা ছিল একটি রাজনৈতিক বিপ্লব। নির্বাচনি বিপ্লব বেশির ভাগই নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে না বরং পূর্বের সংবিধান অনুসরণ করে সংশোধনীর মাধ্যমে। তাই বাংলাদেশে নির্বাচনি বিপ্লব হয়নি, বরং সাধারণ বিপ্লব হয়েছে বলে এখানে বিপ্লবী সংবিধান প্রণয়ন গুরুত্বপূর্ণ। নতুন শাসনকে যে বৈধতা অর্জন করতে হয় তাতে মূল অবদান রাখতে পারে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, মিসর এবং তিউনিসিয়ায় ২০১১-পরবর্তী অভিজ্ঞতা আমাদের সে শিক্ষা দেয়। তাই নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার জন্য বাংলাদেশে নতুন সংবিধান প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে পঞ্চদশ সংশোধনী পর্যালোচনার মাধ্যমে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ফিরে আসতে পারে। তবে তত্ত্বাবধায়ক/অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থায় ফিরে আসা ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে, কারণ এটি হবে সংবিধানের একটি সংশোধনীর মাধ্যমে। বরং নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং নতুন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক/অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনই হবে সর্বোত্তম পদ্ধতি।
বিপ্লবের পর সংবিধান প্রণয়ন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে এমন আরও একটি মূল কারণ হলো- এটি নতুন শাসনের বৈধতার একটি স্বাধীন উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে। যেমনটি আমরা দেখেছি, পুরনো শাসনক্ষমতা হারানোর পরই বিপ্লব শুরু হয় এবং নতুন শাসনব্যবস্থা, যদি এটি সফল হতে হয়, তবে শুধু পুরনো শাসনকে ক্ষমতায় নয় বরং কর্তৃত্বেও প্রতিস্থাপন করতে হবে, তার নিজস্ব সংবিধান প্রতিষ্ঠা ও শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যদি নতুন শাসন কোনো কারণে বৈধতা হারায়, এটি অবিরাম সংগ্রাম এবং ২০১৩ সালের জুলাইয়ে মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাতের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তথা নতুন সংবিধান প্রণয়নের বৈধতার উৎস কী?
যদি অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ-পরবর্তী সময় কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তার উত্তর হবে, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের আচরণের মাধ্যমে বৈধতা পেয়েছে। নতুন শাসন কীভাবে এটি অর্জন করতে পারে বা এ জাতীয় বৈধতার উৎস কী? সাধারণ বিপ্লবী প্রেক্ষাপটে বলা যায় তিনভাবে-
প্রথমটি হলো, পুরনো শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জনগণের পক্ষে তাদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ফলে বিপ্লবী আন্দোলন ও নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে এবং বৈধতা অর্জন করেছে। তবে এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের বিপ্লবগুলো নেতৃত্বহীন বিপ্লবের চেয়ে বেশি সফল হয়ে থাকে। জর্জ ওয়াশিংটন তাঁর বৈধতা নিয়ে আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির নতুন অফিসে, যা বিপ্লবী যুদ্ধের সময় অর্জিত হয়েছিল। পদ গ্রহণে তাঁকে রাজি করানো হয়েছিল। একইভাবে ভারতে বৈধতার এ উৎসটি নেহরুর বাকি জীবন ধরে চলে এবং তাঁর মৃত্যুর পর আরও এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কংগ্রেস পার্টির জন্য অব্যাহত ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় এটি নেলসন ম্যান্ডেলা এবং তাঁর প্রজন্মের বর্ণবাদবিরোধী কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বিপ্লবের সবচেয়ে শক্তিশালী স্টেকহোল্ডার- ছাত্রদের কাছ থেকে বৈধতা পেয়েছে এবং সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। আমি নিশ্চিত নই, বাংলাদেশের বিপ্লবকে নেতৃত্বহীন বিপ্লব বলা যাবে কি না।
বৈধতার দ্বিতীয় উৎস অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রিয়াকর্ম থেকে উদ্ভূত জনগণের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করা অর্থাৎ গণতন্ত্র এবং খাবার বা উন্নত অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের মতো জনপ্রিয় দাবি দিয়ে বিপ্লবের সিংহভাগই শুরু হয়। যেখানে এগুলোতে মানুষ সন্তুষ্ট হয়, তখন বিপ্লবী আন্দোলন স্বতন্ত্রভাবে বৈধ হয়ে যায়। অতএব বাংলাদেশে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এ ধরনের চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা করা (যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ)।
বৈধতার তৃতীয় উৎস হলো- সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া এবং বিষয়বস্তু। যেখানে সংবিধান যুক্তিসংগতভাবে বিপ্লবের বিস্তৃত লক্ষ্য, নীতি এবং আকাঙ্ক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করবে, তখন নতুন শাসন বৈধ বলে গণ্য হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তিউনিসিয়া একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে ছিল একটি নেতৃত্বহীন বিপ্লব এবং সেখানে ঐক্য সরকারের বৈধতার প্রধান উৎস এই ছিল যে, ওখানে বিপ্লব হচ্ছে সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপক সফল অভিজ্ঞতার ফসল। এখানে সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনপ্রিয় গণভোটের প্রয়োজন হয়নি।
অন্যদিকে মুরসির শাসনে এ বৈধতার অভাব ছিল এবং লিবিয়ার সরকারের ক্ষেত্রে বৈধতার তিনটি উৎসেরই অভাব রয়েছে। এগুলো মূলত নেতৃত্বহীন বিপ্লব ছিল, যা জনগণের জন্য বিদ্রোহের ইতিবাচক ফলাফল প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছিল। মিসরের ক্ষেত্রে, বিপ্লবের পর সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া এবং সংবিধান উভয়ই ছিল গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং জনসংখ্যার বড় অংশ তা অনুভব করেছিল। লিবিয়ায় সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া আশঙ্কাজনক ছিল এবং অদূর ভবিষ্যতের জন্য স্থবির হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের নতুন সংবিধানে বিপ্লবের বিস্তৃত লক্ষ্য, নীতি ও আকাঙ্ক্ষাকে যুক্তিসংগতভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পুরনো সংবিধান সংশোধন, বর্ধিত বা সংবিধান পুনর্লিখন করা উচিত কি না তা নিয়ে গণভোট পরিচালনা করা যেতে পারে।
সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাব বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি ভালো পদক্ষেপ। শুধু আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টিকে এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত হবে না। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর সরকারের উচিত তাদের কাজ ও লেনদেনে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা দেখানো। জনগণের মৌলিক চাহিদার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) যত্ন নিতে হবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কখন এবং কীভাবে জাতীয় নির্বাচন হবে সে বিষয়ে একটি গাইডলাইন দিয়ে গণতন্ত্রের রাস্তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পেপার ব্যালট এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সরকারের প্রত্যেককে কথা ও কাজে খুব সতর্ক থাকতে হবে। তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার ও নতুন সংবিধান বৈধতা পাবে।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং সাংবিধানিক আইনের শিক্ষক