অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স সাড়ে পাঁচ মাসের বেশি। জুলাই বিপ্লব ও ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নতুন সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল অনেক। দীর্ঘ ১৫ বছরের বঞ্চনা দূর করে দেশবাসীকে একটু স্বস্তি দেবে- এমন আকাক্সক্ষা ছিল সবার। কিন্তু শেখ হাসিনার পতন ছাড়া আর কোনো সুখবর নেই। দিন যত যাচ্ছে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা তত বেশি বাড়ছে। প্রত্যাশার শূন্যস্থান দুরাশায় পূর্ণ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোথাও কোনো সুখবর নেই। নানামুখী ষড়যন্ত্রের জালে সরকার আটকে পড়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কমেনি মূল্যস্ফীতি। আইএমএফের চাপে ভ্যাট আদায় বাড়াতে শতাধিক পণ্যের শুল্ক-কর বৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। ডলারের দাম বেড়েই চলেছে, ঠিকমতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। আশানুরূপ বাড়েনি রপ্তানি। শৃঙ্খলা ফেরেনি আর্থিক খাতে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক নয়। বেড়েছে সব ধরনের অপরাধ। সরকারের প্রতি আস্থা কমছে রাজনৈতিক দলগুলোর। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো সঠিক সমন্বয় নেই। জনগণের প্রকৃত প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর ও সদর্থক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকা উচিত। খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এই দুই হার এখনো দুই অঙ্কের ঘরে থাকার মানে হলো, নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই বিভিন্ন ফল, রান্নার গ্যাস, মুঠোফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহার, রেস্তোরাঁয় খাবার, বিস্কুট, টিস্যু, ঢেউটিন, রংসহ শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়িয়েছে সরকার। ফলে মধ্য এবং নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়বে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছেন না। সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি ভীতির দেয়াল তৈরি হওয়ায় প্রায় সব ব্যবসায়ী হাত গুটিয়ে বসে আছেন। নতুন বেসরকারি বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায়। দেশে সব উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ। নির্মাণকাজও প্রায় বন্ধ। যে কারণে রড- সিমেন্টের ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) ঋণ, নারী উদ্যোক্তারাও এখন কোথাও থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন না। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়ছে বেকারত্ব। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার ঋণনির্ভর হয়েছে। আইএমএফের ঋণে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। শিল্পে গ্যাসের মূল্য ও শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের সামগ্রিক ব্যবসাবাণিজ্যের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করবে। উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হবে।
নতুন শিক্ষা বছর শুরু হলেও এখনো শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছায়নি। শিক্ষার্থীরা দুই তিনটির বেশি বই না পাওয়ায় লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা কাটেনি। অচলাবস্থার কারণে সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সামাজিক জীবন নিরাপত্তাহীন। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দখলের কারণে মানুষ অতিষ্ঠ। প্রকাশ্যে গুলি করে, কুপিয়ে হত্যার কারণে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নেই মানুষের। মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ব্যাংক খাতে এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। জনগণের আস্থা হারিয়ে দেউলিয়া হওয়ার পথে বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত পেতে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ রয়ে গেছে। ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কোনো পর্যায়ে উল্লেখ করার মতো কোনো সুখবর নেই। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সাধারণ মানুষের জন্য কোনো সুখবর নেই। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু হতাশা কাজ করছে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে হবে। করহার না বাড়িয়ে করের জাল বাড়ানো উচিত ছিল। কর বাড়ায় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ দেশের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না। অর্থনীতির ধীরগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে ভুল আছে। আইএমএফের ফ্রেম থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আইএমএফের পরামর্শ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ঘানার মতো দেশের জন্য নয়। সরবরাহ বাড়াতে হলে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিতে হবে, সুদহার কমাতে হবে। তিনি আরও বলেন, অপ্রয়োজনীয় সরকারি অনেক দপ্তর ও বিভাগ আছে, সেগুলো বিলুপ্ত বা একীভূত করা গেলে সরকারের খরচ কমবে।