মূক, বধির, অন্ধ, পঙ্গু মানুষকে আমরা বলি বিকলাঙ্গ। আবার জড়বুদ্ধিসম্পন্ন যারা, তারাও বিকলাঙ্গ। কেউ জন্মগতভাবে, কেউ দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতিবন্ধী হতে পারেন। তারা কিন্তু অক্ষম নয়। অনেক ক্ষেত্রে সক্ষম। শুধু এ দেশের নয়, বিদেশের বহু প্রতিবন্ধীই প্রমাণ করেছে, দৈহিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা কোনো অনতিক্রম্য বাধা নয়।

আর্ত মানুষের সেবাই হল যথার্থ জীবনসাধনা। ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী’র জমাট অন্ধকারে প্রতিবন্ধীদের জন্য সেবাধর্ম একটি উজ্জ্বল, অনিবার্য দীপশিখার মতো যদি জ্বলতে থাকে, তাহলে আমরা প্রেমের জ্যোতিলোকে উন্নীত হব। কিন্তু এই সেবাধর্ম কীভাবে সম্ভব? প্রতিবন্ধীদের বেসরকারি উদ্যোগ সরকারি উদ্যোগের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও শহরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। প্রতিটি মানুষের কাছে প্রতিবন্ধী সেবা কুপন বেসরকারি উদ্যোগে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। বিত্তবান মানুষের কাছে স্মৃতিস্মারক নিকেতনের আবেদন জানানো যায়। প্রতিবন্ধী সেবাসমিতি গড়ে তোলা যায়। কিন্তু এই কাজগুলো আমাদের দেশে আজ কঠিন কেন? এই জনপদে সুস্থ দেহ-মন সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা মুষ্টিমেয় নয়। এখানে সমস্যা আছে প্রচুর, কিন্তু সমাধানের ব্যাপারে তৎপরতার বড়ো অভাব। আমরা অনেকেই ভুলে যাই যে, প্রতিবন্ধীরা আমাদেরই ঘরের সন্তান।

লোকধর্মকে অস্বীকার না-করেও মানবধর্মের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। মানবধর্মে থাকে মাতৃত্বের কোমল স্পর্শ। সমবেদনার সামান্যতম স্পর্শে আমরা অন্ধ, পঙ্গু, মূক, বধির, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পরিবর্তন ঘটাতে পারি। সমস্ত হীনতা-দীনতার মধ্যেও প্রতিবন্ধী নর-নারীর প্রতি স্বাভাবিক মমত্ব ও সমাত্মবোধ জাগা সম্ভব। প্রথমে এই সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে যে, প্রতিবন্ধীরা সমাজের গ্লানিস্বরূপ নয়। পৃথিবীতে কোনো মানুষই নিজের ইচ্ছায় প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মায় না। প্রতিবন্ধিতা যে নিতান্তই আকস্মিক ব্যাপার এ বৈজ্ঞানিক চেতনাকে ক্রমশ প্রসারিত করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আমাদের সমস্যা কতটুকু সেই তর্কের অবতারণা অত্যন্ত গৌণ হয়ে যায় যখন আমরা দেখি লোভ ও স্বার্থপরতায় আবিল নরপশুরা সমাজক্ষেত্রে অবাধে, নিঃসংকোচে বিচরণ করছে। প্রাণের অধিকার আজ লাভ করছে তারাই, যারা কুৎসিত-হীন-স্বার্থপর। জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে আঁকড়ে ধরছে তারাই যারা মানুষের দুঃখকে দুঃসহতম করে তুলছে, তার পাপকে আরো বীভৎস করে দিচ্ছে, যন্ত্রণাকে আরো প্রলম্বিত করে তুলছে, তার মুক্তির চতুর্দিকে পাকে পাকে আরো কঠোর দুñেদ্যতম নিগড় ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিবন্ধীরা আমাদের জন্য সমস্যা বয়ে আনে না, আমরাই প্রতিবন্ধীদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করি।

আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীরা কীভাবে বেঁচে আছে? তাদেরও যে সামাজিক সত্তা রয়েছে, তারাও যে পূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী অথবা তাদের সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কীভাবেÑ এসবের সন্ধানে আমরা আজও পশ্চাদগামী। সমুদ্রের মধ্যদিয়ে যখন আইসবার্গ ভেসে চলে, তখন তার সামান্য অংশই চোখে পড়ে এবং যেটুকু চোখে পড়ে তা-ও ঢাকা থাকে কুয়াশায়। আমরা প্রতিবন্ধীদের শক্তি বিশালত্ব নিয়ে খুব কমই ভাবি। খ- মানুষের সমাহার এই সমাজে প্রতিবন্ধীদের আরো খ- খ- করে দেখি। এ দেখা তাদের দুর্বল করে, সামাজিক প্রতিষ্ঠা সুরক্ষিত করে না।

১৯৮১ সালে প্রতিবন্ধীদের সার্বিক কল্যাণের উদ্দেশ্য জাতিসংঘ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’ উদযাপন করেছিল। সে ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত আছে। প্রতিবন্ধীদের শুধু সমাজে স্বনির্ভর করে তোলাই নয়, তাদের আত্মিক বিকাশের কর্মসূচিও বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের আজ গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র এ ব্যাপারে বিভিন্ন স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও উদ্যোগী হতে পারে প্রতিবন্ধী-কল্যাণকর্মে। আসল কথা, চেতনারঙে রাঙাতে হবে প্রতিবন্ধী কর্মসূচিকে। হস্তচালন যোগ্য সাইকেল-রিকশা, দৃষ্টিসহায়ক যন্ত্র, প্রতিসহায়ক যন্ত্রগুলো প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে বিতরণের সময় দেখতে হবে যেন তারা আমাদের করুণার পাত্র-পাত্রী হয়ে না ওঠে। কারণ, ‘প্রতিবন্ধী’ সমাজ ও মনুষ্যত্বের পরাভূত পরিণতি নয়, পরমতম লজ্জার কুটিল-সর্পিল নেপথ্য নয়। প্রতিবন্ধীদের গভীরতর জীবন আছে, পূর্ণ মানবতা আছে, সার্থক সমাজচেতনা আছে। এদের অনেকের দ্বারাই শুভ চেতনার অরুণোদয় সম্ভব। এদের অন্ধকারে রেখে আমরা যেন আত্মহননের মধ্যে নিঃশেষিত না হই।

সুখের কথা ইতোমধ্যে দেশের প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী করে তোলার অনুকূলে বার্ষিক অনুদান দেবার চিন্তা ভাবনা চলছে দেয়া হচ্ছে ভাতাও। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষিত রয়েছে পদ। কোনো কোনো জেলায় প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সারাদেশে এখনই প্রয়োজন প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক পদ্ধতির স্কুল স্থাপন, যেখানে বিশেষ শিক্ষণ-প্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা নিযুক্ত হবেন। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে দেশে একাধিক সংস্থা কাজ করে চলেছে।

অস্থির সময়ের অভিঘাত আমাদের নিয়ত স্পন্দিত করবে, পরিত্রাণহীন ক্ষমতা-কাঠামো আমাদের নানাভাবে শোষণ করবে। তাই একলা চলার মন্ত্রদীক্ষা আর নয়, এবার সেবাদলে দীক্ষা গ্রহণের সময় এসেছে। এখন, ঞযব ংঃৎড়হমবংঃ সধহ রহ ড়িৎষফ রং যব, যিড় ংঃধহফং রিঃয ড়ঃযবৎং. হেনরিক ইবসেনের নাটক অহ ঊহবসু ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব এর নায়কের বিপরীতে চিন্তা। প্রতিবন্ধীদের পরিণতি যেন শোচনীয় ও মর্মবিদারী না হয়। আমাদের চিত্তের বিকাশ সাধনে তারা যেন দুর্ভাবনামুক্ত হন। আমাদের সমাজ যেন তাদের মানসিক অত্যাচার থেকে মুক্তি দেয়। প্রতিবন্ধীদের নৈতিক শক্তিকে জাগিয়ে তাদের শুভ ও কল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদেরই।

প্রতি বছর দুর্ঘটনাজনিত কারণে বিশ্বের বহু মানুষের অঙ্গহানি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এভাবে প্রতিবন্ধী মানুষ শুধু পরিবারের কাছেই নয়, সমাজের কাছেও বোঝা হয়ে ওঠেন। বর্তমান বিশ্বে ৭০ কোটি প্রতিবন্ধী রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিটি রাষ্ট্রেই বেশ বড় সংখ্যায় প্রতিবন্ধী লোক থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৪৫টি রাষ্ট্রই তাদের দেশের প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর বিপরীতের অধিকাংশ দেশেই প্রতিবন্ধীদের বাধ্য হয়েই বেআইনি কার্যকলাপ, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদিতে নিযুক্ত থাকতে হয়। এই অসহায় প্রতিবন্ধীদের সহায়তার সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য ইতিবাচক সগযোগিতার দিশা দেখাতে হবে জাতিসংঘকে। প্রতিবন্ধীদের মনে দুঃখ জয়ের আশা, জীবনের আনন্দ, মানুষের মর্যাদা ও স্বীয় শক্তি সম্ভাবনার উপলব্ধি ও উপভোগের প্রত্যাশা একান্ত স্বাভাবিক। আজ স্বার্থ-ঠুলি দু’চোখ এটে বসে আছি বলেই এদের মর্যাদার আসনে আমরা প্রতিষ্ঠত করতে অভ্যস্ত নই।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সদস্য, জেলা সমাজ কল্যাণ পরিষদ, সিলেট।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews