গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট সাময়িকীর ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) Democracy Index 2023 (গণতন্ত্র সূচক ২০২৩) প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ১৬৭ দেশ ও অঞ্চলের গণতন্ত্র পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ১০ স্কোরের ভিত্তিতে এই সূচক তৈরি করা হয়েছে। গণতন্ত্র সূচক ২০২৩-এর প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, ‘It was an inauspicious year for democracy with the average global score falling to its lowest level since the index began in 2006. Less than 8% of the world’s population live in a full democracy, while almost 40% live under authoritarian rule-a share that has been creeping up in recent years’, যার অর্থ দাঁড়ায়, ২০২৩ সালটি বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের জন্য একটি অশুভ বছর ছিল। ২০০৬ সালে সূচক প্রকাশ শুরু হওয়ার পর থেকে গত বছরই বৈশ্বিক গড় স্কোর সর্বনিু স্তরে নেমে গেছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশের কম যখন গণতন্ত্রে বাস করে, তখন প্রায় ৪০ শতাংশের বাস কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ হার বেড়েই চলেছে। ইআইইউ-এর এই সূচক পাঁচটি মানদণ্ড-নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও বহুদলীয় ব্যবস্থা, নাগরিক স্বাধীনতা, সরকারের কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এসব মানদণ্ড বিবেচনা করে পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, মিশ্র শাসন এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন-এই চার শ্রেণিতে দেশগুলোকে ভাগ করা হয়েছে। দি ইকোনমিস্টের মতে, ১০ স্কোরের ভিত্তিতে কোনো দেশের গড় স্কোর ৮-এর বেশি হলে পূর্ণ গণতন্ত্র, ৬ থেকে ৮ হলে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, ৪ থেকে ৬ হলে মিশ্র শাসন এবং ৪-এর নিচে হলে সেই দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন চালু রয়েছে।

এবারের সূচকে ক্রমানুসারে শীর্ষ পাঁচটি গণতান্ত্রিক দেশ হলো-নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও আইসল্যান্ড। অন্যদিকে এবারের সূচকে গত বছরের মতো একেবারে তলানিতে জায়গা করে নিয়েছে আফগানিস্তান। এর উপরের দুই অবস্থানে রয়েছে মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়া।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটির অবস্থান ৪১তম। এরপর ৭০তম অবস্থানে শ্রীলংকা। বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে ভুটান (৮১তম), নেপাল (৯৮তম) ও পাকিস্তান (১১৮তম)।

ইআইইউ-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এবারের সূচকে ১৬৭টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ২৪টিতে পূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে। ৫০টির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। ৩৪টি দেশ ও অঞ্চলে হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। আর সবচেয়ে বেশি ৫৯টির শাসনব্যবস্থা কর্তৃত্ববাদী।

এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। গত বছরের তুলনায় এবারের সূচকে বাংলাদেশ দুই ধাপ পিছিয়েছে। ২০২২ সালের ইআইইউ-এর গণতন্ত্র সূচকে ৫.৯৯ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৩তম। আর ২০২৩ সালের সূচকে ৫.৮৭ স্কোর নিয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ এখন ৭৫তম অবস্থানে। অবশ্য আগের মতোই বাংলাদেশ হাইব্রিড রেজিম বা মিশ্র শাসন শ্রেণিতে রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে বিএনপির শাসনামলে ইআইইউ প্রকাশিত প্রথম ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে ৬.১১ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ত্রুটিপূর্ণ শ্রেণিতে। এরপর ১৭ বছর ধরে বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ নিচের শ্রেণিতে তথা হাইব্রিড রেজিম বা মিশ্র শাসন শ্রেণিতে অবস্থান করছে। হাইব্রিড রেজিমের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলা হয়েছে : ‘A hybrid regime is defined as one where elections have substantial irregularities that often prevent them from being both free and fair. Government pressure on opposition parties and candidates may be common. Serious weaknesses are more prevalent than in flawed democracies-in political culture, functioning of government and political participation. Corruption tends to be widespread and the rule of law is weak. Civil society is weak. Typically, there is harassment of and pressure on journalists, and the judiciary is not independent’, সংক্ষেপে যার অর্থ দাঁড়ায়-হাইব্রিড রেজিম বলতে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। সরকার বিরোধী দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। হাইব্রিড রেজিমে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সরকারের কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়, তা ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, দুর্বল আইনের শাসন, দুর্বল নাগরিক সমাজ, সাংবাদিকদের ওপর চাপ ও হয়রানি, নিয়ন্ত্রিত বিচারব্যবস্থা-এগুলো হাইব্রিড রেজিমের বৈশিষ্ট্য। উল্লেখ্য, দেশে ১৭ বছর ধরে হাইব্রিড রেজিমে অবস্থানের প্রথম দুবছর সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ শাসন করেছে। এরপর ১৫ বছর বিরতিহীনভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ।

যে পাঁচটি মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে ইআইইউ বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচক ২০২৩ তৈরি করেছে, সেগুলোর প্রথমটি হলো নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও বহুদলীয় ব্যবস্থা। জন্মের পর থেকে বাংলাদেশ এ মানদণ্ডে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। দেশে এ যাবৎ ১২টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তাছাড়া বিএনপি শাসনামলে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ (১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি) এবং আওয়ামী লীগ শাসনামলে অনুষ্ঠিত দশম (২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি) জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। তবে এ মানদণ্ডেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ৭.৪২ শতাংশ। ইআইইউ-এর গণতন্ত্র সূচক ২০২৪-এ অংশগ্রহণমূলক না হওয়া দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন (২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি) বিবেচনায় আসবে।

দেশে নাগরিক স্বাধীনতা সুরক্ষার ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। সংবিধান প্রদত্ত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো মানবাধিকারবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ২০২২ সালের আগস্টে ঢাকা সফরকারী জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। সফর শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘নির্যাতনবিরোধী কমিটিসহ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের বিভিন্ন কমিটি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ শুধু দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অধিকার গ্রুপ করেছে এমন নয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও স্বীকার করেছে যে, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ অস্বীকার না করে তা স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করা যেতে পারে।’ প্রস্তাবিত ওই কমিশনে ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে সরকার নিবিড়ভাবে কাজ করবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে কমিশন কীভাবে গঠিত হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের দপ্তর তৈরি আছে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। সরকার ব্যাচেলেটের এ প্রস্তাব আমলে নেয়নি। উল্লেখ্য, এবার পাঁচ মানদণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম স্কোর করেছে নাগরিক স্বাধীনতায়। স্কোর হলো ৪.৭১।

সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলা যায়, ১৫ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষেত্রে লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করলেও এ সময়ে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। শাসক দলের যুক্তি অনেকটা এ রকম-‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’। নির্ভেজাল গণতন্ত্র অনুসরণ করে যে উন্নয়ন করা যায়, উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে তাকালে তার অকাট্য প্রমাণ মেলে।

রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলতে সাধারণত এমন অবস্থাকে বোঝায়, যেখানে প্রশাসনের সব পর্যায়ে কার্যসম্পাদনের জন্য জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এবং সমস্যা ও চাহিদা সমাধানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে তাদের মতামত নেওয়াকে গুরুত্ব দেবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে অন্যান্য পর্যায়ে জনস্বার্থবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা চালু রয়েছে। ফলে এসব বিষয়ে জনগণের ভূমিকা নেই বললেই চলে। এ মানদণ্ডে বাংলাদেশের স্কোর হলো ৫.৫৬।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশে অসুস্থ রাজনীতি বিরাজ করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরুতেই সহিষ্ণুতা, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব দেখা দেয়। স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময়ে এসব ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাজনীতির মাঠের শত্রুতা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের, বিশেষ করে দেশের তিনটি বড় দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকেও প্রভাবিত করেছে। বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সহাবস্থানে বিশ্বাসী নয়। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র ও নেতৃত্বচর্চার অনুপস্থিতি, বড় দুটি দলের মধ্যে সহাবস্থানের মনোভাবের অভাব, তাদের পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যাবলির মধ্যে অন্যতম।।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? গণতন্ত্রের উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই, সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। তাই জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হয়, সে উপায় খুঁজে বের করতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেই এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনস্বীকৃত নাগরিক স্বাধীনতার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়নে বড় দলগুলোর উচিত হবে একে অপরকে শত্রু না ভেবে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা। দেশ বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে উন্নতি করে সম্মানজনক অবস্থানে উঠে আসুক-এটাই জনগণের প্রত্যাশা।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews