সময়ের হিসেবে ৯ বছর। টাকার হিসেবটা ৮ হাজার কোটি টাকা। ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) নামে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পুরো টাকাটাই নিজেদের পকেটে পোরা হয়েছে। ফোরামের সব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানাধীন। আর ওই টাকা লুটপাট করতে ব্যবহার করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি)। সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বিষয়টি টেলিযোগাযোগ খাতে ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট। কিন্তু এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি। ব্যবসা সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রতিবাদের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের নানা ধরনের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে থামিয়ে রাখা হয়। একই লাইসেন্স নিয়ে কেউ হাঁকিয়েছেন বিএমডব্লিউ আবার কেউ ঢাকার রাস্তায় ঘুরেছেন রিকশা ও লোকাল বাসে চেপে। বিদেশ থেকে ফোন এলে বা দেশ থেকে বিদেশে ফোন করলে সেটা সরাসরি হ্যান্ডসেটে আসে না। রিংটোন বাজে কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে। এসব ধাপ হচ্ছে গেটওয়ে। বিদেশ থেকে প্রথমে কল আসে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ অপারেটরের কাছে। এরপর যায় ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ বা আইসিএক্স-এ। এই এক্সচেঞ্জ অপারেটর পাঠিয়ে দেন নির্ধারিত মোবাইল অথবা ল্যান্ডফোন গ্রাহককে। তখন পরীক্ষামূলক তিন থেকে ছয় মাসের কথা বলা হলেও এখনো চলছে এই সিন্ডিকেট বাণিজ্য।
যে কৌশলে কুক্ষিগত করা হয় আইজিডব্লিউ ব্যবসা : সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে সরকারি দলের কয়েকজন নেতা মিলে ২০১৫ সালে এ পরিকল্পনা তৈরি করেন। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানাতেও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা আছেন। অনেকটা চাপে পড়েই বিটিআরসিকে তাতে সায় দিতে হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) নামের এ সংগঠনে। সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বের পাশাপাশি তার ছেলে শায়ান রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এ ছক সম্পন্ন করা হয়। বিটিআরসিতে আইজিডব্লিও ফোরামের প্রায় সব বৈঠকেই শায়ান নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। ২০১৫ সালে দেশে মোট ২৯টি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটর থাকলেও তাদের সংগঠন ‘আইওএফ’ এর মধ্যে থেকে সাত আইজিডব্লিউ আন্তর্জাতিক কল পরিচালনায় কর্তৃত্ব পায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইউনিক ইনফোওয়ে, ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশনস, রুটস কমিউনিকেশনস, গ্লোবাল ভয়েস, বাংলা ট্র্যাক ও নভো টেলিকম। নতুন প্রক্রিয়া চালুর সে সময়ের হিসাবে (২০১৫) প্রতিমাসে মোবাইল অপারেটররা ১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আইসিএক্সগুলো ১৬ কোটি টাকা, বিটিআরসি প্রায় ৪৭ কোটি টাকা রাজস্ব হারায়। অন্যদিকে আইজিডব্লিউগুলোর লাভ মাসে ৭০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ কোটি টাকা হয়। সবচেয়ে বেশি লাভ পায় নিয়ন্ত্রণকারী এই সাত প্রতিষ্ঠান।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরীক্ষামূলক প্ল্যাটফরমের তকমা দিয়ে একটি অবৈধ লেয়ার তৈরি করে আইনের বেড়াজালে সরকারের যে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের ফর্মুলা বন্দোবস্ত হয়েছে তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পরও আইওএফের নামে আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রাজস্ব থেকে প্রতিদিন যে কোটি কোটি টাকার লুটপাট অব্যাহত রাখা হয়েছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। বিটিআরসি কেন এ প্রথা এখনো চালু রেখেছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বাংলাদেশ কনটেক্সটে আইওএফের কোনো প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক সুবিধা, অর্থ পাচার বন্ধ করতে হলে এ স্তরটা দ্রুত তুলে নিতে হবে। টেলিকম সেক্টরে দীর্ঘদিন একটি কথা শোনা যায় যে, সাবেক ডাক ও টেলিযোযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের মন্ত্রিত্ব চলে গিয়েছিল আইওএফকে অনৈতিক সুবিধা দিতে সম্মত না হওয়ার কারণে। এ বিষয়টিরও একটি তদন্ত হওয়া উচিত।