কামরুল হাসান আমাদের পথিকৃৎ শিল্পীদের একজন। কোনো সন্দেহ নেই তিনি চিরকালের আধুনিক। আমাদের দেশজ গ্রামীণ বা ফোক বিষয়গুলোকে তিনি আধুনিকায়িত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এ দেশের শিল্পকর্মে এবং তাঁর নিজের মতো করে। প্রচুর ছবি এঁকেছেন; এত বেশি ছবি এঁকেছেন যে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর কাজের মধ্যে একটা গতি ছিল এবং শিল্পগুণে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। এদিক থেকে এ দেশে তিনি সফল। দেশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশ তাঁকে যথার্থ মূল্য দিতে পারেনি। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করে গেছেন কামরুল হাসান। এ দেশে যে মাধ্যমগুলো তখন চর্চিত হতো শিল্পে, তার সবকটাতেই প্রায় কাজ করেছেন। রেখাচিত্রে তিনি বিরল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। জলরঙেরও প্রচুর কাজ আছে। তখন তেলরং খুব জনপ্রিয় ছিল; আজকের মতো অ্যাক্রেলিক তখন ছিল না। তেলরঙের ছবি এঁকেছেন প্রচুর। তাঁর রেখাচিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য, মুহূর্তের মধ্যে আঁকতেন। এতে ছবির অভিব্যক্তি আর এক্সপ্রেশনটা ধরা পড়ত। পরবর্তী সময়ে সেই অভিব্যক্তি দেখেই আমরা কামরুল হাসানের ছবি চিহ্নিত করতে পারতাম। নিজস্ব একটা শৈলী তৈরি হয়েছিল। এমন নিজস্বতা প্রচুর কাজ করলে শিল্পীদের তৈরি হয়ে যায়।
এক বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। যেমন ব্যক্তিত্ব কোনো দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। এমন ব্যক্তিত্বের শিল্পী আমরা পেয়েছিলাম কয়েকজনই– জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এসএম সুলতান। তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল মনে রাখার মতো। এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের আমরাও একটু আলাদা করেই রাখতে চাই। কামরুল হাসান নিজস্ব সত্তা নিয়ে আপনাতেই আলাদা ছিলেন। যে পরিমাণ কাজ তিনি করেছেন তা কোনো শিল্পীর জন্য উদাহরণস্বরূপ।
একটা পরামর্শ আছে আমার, ব্যক্তিগত। ঢাকার ভেতরই তাঁর অনেক কাজ রয়েছে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সংগ্রহে। আমার মনে হয়, সরকার তাঁর কাজগুলো রক্ষার উদ্যোগ নিতে পারে। কাজগুলোকে একসঙ্গে করে জাদুঘরে রাখতে পারে। শুধু কামরুল হাসানের জন্য নিবেদিত আলাদা জাদুঘর হতে পারে এবং আমি মনে করি, অদূর ভবিষ্যতে এই জাদুঘর হওয়া উচিত। ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহে থাকা কাজগুলো সংগ্রাহকদের কাছে সরকার চাইতে পারে। বলতে পারে, কামরুল হাসানের মতো শিল্পীর কাজ ব্যক্তিগত সংগ্রহে না রেখে জাদুঘরে রাখলে সবার জন্য ভালো হয়। সরকার চাইলে এমন নীতি করতে পারে, বাংলাদেশের বিশেষ কয়েকজন শিল্পীর কাজ, দেশের সম্পদ সুতরাং সরকার কর্তৃক রক্ষণীয়। এটা আমার পরামর্শমাত্র। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানদের ছবিগুলো যেন বিদেশে না যায়, বরং দেশে প্রদর্শিত হয়, সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
কামরুল হাসান একজন বটবৃক্ষের মতো। নিজেরাই শিল্পের আশ্রয় তৈরি করে গেছেন এ দেশে। শিল্পবোধের পাশাপাশি, কামরুল হাসানের রাজনীতিবোধ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তাঁর পোস্টারগুলো তো কিংবদন্তি। ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ ক্যাপশন দিয়ে তাঁর যে পোস্টার, কী তীব্র। জনমনে কী ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল ওটার। মানুষ লাখ লাখ কপি তৈরি করেছে। এত বিপুল মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারা শিল্পীর অনবদ্য ব্যাপার।
আমাদের একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনও কিন্তু তাদের তরুণ বয়সে ভেতরে ভেতরে হচ্ছিল। চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভেতর একটা বন্ধন ছিল। কবি জসিম উদ্দীনের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল; সখ্য ছিল সরদার জয়েনউদ্দিনের সঙ্গে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কামরুল হাসান অন্যতম।
তখনকার সময়ে আমরা অবয়বপ্রধান চিত্রকর্মের একটা সময়ে বাস করতাম। কামরুল হাসানের ছবিতেও তার প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া তারা ব্রিটিশ স্কুল থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং ভারতীয় ছবি কালীঘাট পটচিত্র, এসবের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। নিজস্ব শৈলী তৈরি করেছেন। আজকে আমরা আধুনিক হতে চেষ্টা করছি, বিমূর্ত আঁকছি। ওই সময়টা এমন ছিল না। অবয়বের মধ্যেই আমাদের বিচরণ ছিল। মানুষ ছাড়াও প্রকৃতির অন্যান্য অনুষঙ্গ অবয়বী রূপ ধরে তাঁর ও তাঁর সময়ের শিল্পীদের চিত্রকর্মে এসেছে।
তাঁর কাজের গতির কথা বলেছি। আরও একটি বিষয় হলো, তাঁর কাজে আত্মা প্রবিষ্ট হতো। শিল্পী যখন প্রচুর কাজ করেন, তখন ধীরে ধীরে তাঁর কাজে একটা গতি স্থাপিত হয়, কাজের ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। প্রচুর কাজ করলে প্রাণ আপনাতেই আসে। কামরুল হাসানের এসেছিল। কেন সর্বক্ষণ কাজ করতেন ক্লান্তিহীন? কথায় বলে, ভগবানকে ধরা যায় না, তিনি ধরা দেন। শিল্প হচ্ছে ভগবানের মতোই। তাকে ধরা যায় না। কিন্তু প্রচুর কাজ করতে থাকলে, সাধনার ভেতর থাকলে শিল্প ধরা দেয়। কামরুল হাসানের কাছে শিল্প ধরা দিয়েছিল।
শিক্ষক হিসেবে তিনি খুব অমায়িক ছিলেন। আমার মনে পড়ে, যেদিন তিনি মারা গেলেন, সেদিন চারুকলায় এসেছিলেন। বললেন, ‘আমি খাব, সিরাজকে ডেকে দাও’– বলে তিনি কমনরুমে বসলেন। এখনও মনে পড়ে। আমরা তো কত ছোট ছিলাম তাঁর কাছে। আদর করতেন আমাদের। তাঁকে রাশভারী মানুষ মনে হতো, কিন্তু তাঁকে আমরা ভয় পেতাম না। তিনি ডাক দিতেন খুব সুন্দর করে। মনে হতো, আমি বুঝি তাঁর পরিচিত। সিনিয়র-জুনিয়রের কোনো বিচার ছিল না। সবাইকে আপন মনে করতেন। সেই যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খাব, সিরাজকে ডেকে দাও’– কথাটা এখনও মনে বাজে। আমি ডেকে দিয়ে চলে গিয়েছিলাম। তাঁর খাওয়া হয়েছিল কিনা জানা হয়নি।
মৃত্যু দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন।