শুক্রবার তুর্কমেনিস্তানের আশগাবাতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তাঁর ইরানি সমকক্ষ মাসুদ পেজেশকিয়ানের মধ্যে তড়িঘড়ি এক সাক্ষাৎ হয়েছে। বলা যায়, দুই নেতার এ সাক্ষাৎ ইতোমধ্যে সৃষ্ট রহস্যকে বরং আরও ঘনীভূত করেছে। এটি ছিল তাদের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ। এমনকি বৈঠকের পর পুতিন কোনো প্রেস কনফারেন্সও করলেন না।
কেন এ ধরনের বৈঠকের দরকার হলো, তা একটি আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ২২-২৪ অক্টোবর দুই নেতার ব্রিকস সম্মেলনের পাশাপাশি দু-একদিনের মধ্যে কাজানে বৈঠকে বসার কথা। বহু শতাব্দী ধরে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে খারাপ সম্পর্ক ছিল। তাদের কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তির পরও বিষয়টি জটিল থেকে গেছে। বিতর্কিত জাঙ্গেজুর করিডোর নিয়ে তাদের স্বার্থের সংঘাত কারও অজানা নয়। দুটি দেশই ইউরোপের জ্বালানি বাজারে সম্ভাব্য প্রতিযোগী এবং কৌশলগত স্বাধীনতা রক্ষায় উভয়ের অবস্থান বেশ কঠোর। আগামী দিনের বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থায় তাদের অংশীদারিত্ব সামগ্রিকভাবে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করার পথে বাধা। আশগাবাতে পেজেশকিয়ান পুতিনকে ইঙ্গিত করে তাদের প্রস্তাবিত কৌশলগত চুক্তিতে শিগগির স্বাক্ষর করা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছিলেন। পুতিন ১৮ সেপ্টেম্বর খসড়া চুক্তিটি অনুমোদন করেছিলেন। তার পরও কী কারণে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটি আটকে আছে, তার একটি ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। পেজেশকিয়ান অনুষ্ঠানটি কাজানে হতে পারে বলে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু রাশিয়া তাতে গড়িমসি করছিল।
এ পরিস্থিতি কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। তেহরান অর্থ পরিশোধ করার পরও রাশিয়া এস-৩০০ মোবাইল সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম হস্তান্তরে অপ্রত্যাশিত দেরি করেছিল। নিছক ক্ষোভের কারণে ইরান রাশিয়ার প্রতিরক্ষা রপ্তানি সংস্থার বিরুদ্ধে ৪ বিলিয়ন ডলারের মামলা করেছিল এবং দেশটি নিজস্ব দূরপাল্লার মোবাইল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বাভার-৩৭৩ তৈরির কাজ শুরু করে।
সোজা কথা, রাশিয়া মার্কিন-ইসরায়েলের চাপের মুখে পড়েছিল। ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার অস্ত্র হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক বিষয় এখনও মাথায় রাখতে হচ্ছে। পেজেশকিয়ান তেহরানে ফিরে এসে মিডিয়ার সামনে পুতিনের সঙ্গে তাঁর আলাপ তুলে ধরেছিলেন। তিনি পুতিনকে বলেছেন, ‘গাজা ও লেবাননে সংঘটিত ইহুদিদের অপরাধ নিয়ে রাশিয়ার আরও বেশি কার্যকরভাবে কাজ করা উচিত।’
আদতে মস্কো বাস্তব কারণেই তার ‘নিরপেক্ষতা’ বজায় রেখে চলছে, যা অবশ্যই তেহরানের কাজে আসে না। একইভাবে পুতিন সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ফোন রিসিভ করেননি বলে জানা গেছে! সম্ভবত রাশিয়া ও ইসরায়েলের পারস্পরিক গভীর সমঝোতায় আমাদের অজান্তেই পরিবর্তন এসেছে।
এটি বোধগম্য। কারণ রাশিয়া খুব মনোযোগ দিয়ে মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্কের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে। দ্বিধার জায়গা হলো, যেখানে মার্কিন সাহায্য ছাড়া ইরানের অবকাঠামোতে কোনো শক্তিশালী হামলা অসম্ভব এবং ইরান আক্রমণে যে কোনো ইসরায়েলি পরিকল্পনার জন্য পেন্টাগনের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার প্রয়োজন হবে, সেখানে বাইডেন প্রশাসন দ্বিধা ও সন্দেহ নিয়ে আশা করে, নেতানিয়াহু পরিকল্পিত সামরিক পদক্ষেপের ব্যাপারে তাদের নিয়মিত অবহিত করবে। অন্যদিকে, পেজেশকিয়ান সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মস্কোতে অস্বস্তি রয়েছে। কারণ পশ্চিমের সঙ্গে ইরান আলোচনার পুনঃপ্রবর্তনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তেহরান ও মস্কোর মধ্যে উচ্চস্তরের কূটনৈতিক আসা-যাওয়া এখন আগের মতো হচ্ছে না, যতটা প্রয়াত ইব্রাহিম রাইসির সময় ছিল।
গত সপ্তাহে শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারা বেশ জোরেশোরে নিশ্চিত করেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা সত্ত্বেও তেহরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি ‘এগিয়ে’ নিয়ে যাচ্ছে না। সপ্তাহের শুরুতে সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নস জনসমক্ষে এক মন্তব্য করলে ওয়াশিংটনে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের দপ্তরের (ওডিএনআই) এক মুখপাত্র এ কথা বলেছিলেন। আশগাবাত বৈঠকে পেজেশকিয়ান পুতিনকে বলেছিলেন, ইরান ও রাশিয়ার পারস্পরিক ও পরিপূরক সহযোগিতার সুযোগ আছে এবং দুটি দেশ একে অপরকে সাহায্য করতে পারে। পেজেশকিয়ান জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আন্তরিক ও কৌশলগত।’ তিনি এও যোগ করেছেন, ‘বৈশ্বিক বিষয়ে আমাদের অবস্থান অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় একে অপরের কাছাকাছি।’
তবে পেজেশকিয়ান মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক উন্নত হবে এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য আরও শক্তিশালী হবে। এটি আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এই উদ্দেশ্য অর্জনে আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে এবং এই প্রচেষ্টাগুলোতে একে অপরকে সহায়তা করা আমাদের কর্তব্য। আমরা একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করি এবং আমাদের আন্তর্জাতিক অবস্থানে অনেক মিল রয়েছে।’
তাৎপর্যপূর্ণ, আশগাবাত বৈঠকে পুতিন বা পেজেশকিয়ান কেউই দুই দেশের নিজ নিজ বৈদেশিক নীতির মূলে একটি কৌশলগত অভিন্নতার দাবি করেননি। তবুও পেজেশকিয়ান পুতিনকে আশ্বস্ত করেছেন, তিনি আসন্ন ব্রিকস সম্মেলনে যোগদানের জন্য উন্মুখ এবং ‘আমরা সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে নথি অনুমোদন ও স্বাক্ষর করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করব।’
এম কে ভদ্রকুমার: ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম