সাদা-কালো

সিপিবিসহ বামদের ওপর হামলার হেতু কী?

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান বিশেষত দেশের রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি করেছে বলে এর সংগঠক ও সমর্থকরা শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন। কিন্তু আমরা আসলে এগোচ্ছি, না পেছাচ্ছি– জনপরিসরে ইতোমধ্যে এ সংশয়ও জেগে উঠেছে। গণঅভ্যুত্থান এ দেশে আগেও হয়েছে। বরাবরই দেখা গেছে, বিজয়ী পক্ষ বিজিতদের ওপর ঝাল মেটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কখনোই এখনকার মতো পরিস্থিতি হয়নি।

শুধু কি তাই? কখনও কেউ শুনেছে, একসঙ্গে আন্দোলন করে সরকার উৎখাতের পর অভ্যুত্থানের রেশ না কাটতেই এর শক্তিশালী অংশ দুর্বল অংশকেও বিজিতদের দোসর আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করেছে? গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের সরাসরি ইন্ধনে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা দিয়ে জাতীয় পার্টির অফিস জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে আলোচনার পরিসর এ নিবন্ধ নয়। এতে রাজনীতির অন্য কিছু হিসাব-নিকাশ আছে, যা এখানে প্রাসঙ্গিকও নয়। তবে গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন থাকার পেছনে জাতীয় পার্টির যথেষ্ট ভূমিকা থাকলেও এটা অস্বীকার যাবে না– বিশেষত গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি শিক্ষার্থীদের পক্ষেই ছিল; এমনকি সময়ে সময়ে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর কথাও উচ্চারণ করেছেন এর নেতারা।

গত ২ নভেম্বর শিল্পকলায় নারী ও নিম্নবর্গের শোষিত-লাঞ্ছিত হওয়ার স্বরূপসন্ধানী নিত্যপুরাণ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে গায়ের জোরে বন্ধ করে দেওয়া হলো। এর প্রতিবাদ করতে গেলে নাটক রচনা ও অভিনয়ের কারণে দেশ-বিদেশে খ্যাত বর্ষীয়ান মামুনুর রশীদ ও তাঁর সহযোগীদের ওপর হামলা হলো। অথচ মামুনুর রশীদসহ আক্রান্ত নাট্যকর্মীর অধিকাংশই সাম্প্রতিক আন্দোলনে মাঠে ছিলেন। 

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি এবং তার সহযোগী দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীর সঙ্গে যা হয়েছে, তা তো আরও বিস্ময়কর। নানা কারণে অনেক ক্ষয়ের পরও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পূর্বাপর সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে লড়াই করা সিপিবি এখনও দেশের প্রধান বামপন্থি দল। সমকালসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, ১৩ নভেম্বর বুধবার পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সিপিবির পথসভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে ব্যানার-মাইক কেড়ে নেওয়া ও চেয়ার ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পথসভাটি ছিল জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে অনতিবিলম্বে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধসহ বেশ কিছু দাবিতে দলটির কেন্দ্র ঘোষিত ‘জাগরণ যাত্রা’ কর্মসূচির অংশ। শরীয়তপুরে একই কর্মসূচি পালন করতে গেলে দলটির নেতাকর্মীর ওপর দ্বিতীয় হামলার ঘটনাটি ঘটে ১৬ নভেম্বর। সেখানে কর্মসূচিটি পালিত হচ্ছিল সিপিবি ও অন্য কয়েকটি বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোটের ব্যানারে। ফলে অন্য বাম দলের স্থানীয় নেতাকর্মীও সেদিন হামলার শিকার হন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, হামলাটি চালায় স্থানীয় বিএনপির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোক। 

দ্য ডেইলি স্টার বাংলার খবর অনুসারে, গত ১৫ নভেম্বর জামালপুরে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন- সরিষাবাড়ী উপজেলা শাখার সম্মেলন হামলার মাধ্যমে পণ্ড করে দেয় ‘দুর্বৃত্তরা’। ছাত্র ইউনিয়ন সিপিবির গণসংগঠন। যদিও সংগঠনটি এখন নানা কারণে দ্বিখণ্ডিত এবং হামলার শিকার নেতাকর্মী ‘বিদ্রোহী’ অংশভুক্ত; এরা সিপিবির শীর্ষ নেতাদের একটা অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত। তদুপরি এরাও বাম রাজনীতিরই অনুসারী। সাম্প্রতিক সরকার পতন আন্দোলনে এদের ভালোই ভূমিকা ছিল।

মজার ব্যাপার হলো, নাট্যকর্মীদের ওপর হামলার সময় যেমন, তেমনি সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের ওপর হামলার সময়ও হামলাকারীরা অজুহাত দিয়েছে– কর্মসূচি পালনকারীরা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দোসর। অথচ বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্য শরিকদের মতো সিপিবি বিএনপি ও তার মিত্রদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন বর্জনই করেনি শুধু; সেই ২০০৯ সাল থেকেই তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। 

বিগত তিন মাসে সংঘটিত প্রায় সব সহিংসতাকে সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে জনরোষ হিসেবে দেখানোর দুঃখজনক প্রবণতা দেখা গেছে। উল্লিখিত হামলাগুলোর সঙ্গে জড়িতরা সেখান থেকেই আশকারা পেয়েছে বললে সম্ভবত ভুল হয় না। লক্ষণীয়, সিপিবি ও তার মিত্র বাম দলগুলো আওয়ামী লীগবিরোধী হলেও বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সেই হিসাবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানত গণঅভ্যুত্থানের শরিকদের একাংশের জাতীয় সংগীত ও ১৯৭২ সালের সংবিধান পরিবর্তনের চিন্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তারা। ফলে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন সরকারবিরোধী ডান-বাম সবাইকে এক মঞ্চে তুললেও সেই পুরোনো মেরূকরণের রাজনীতির অনুসারী গণঅভ্যুত্থানের উদ্যোক্তারা অচিরেই সিপিবি ও তার মিত্রদের আওয়ামী লীগের দোসর জ্ঞান করতে শুরু করে। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ ও তার কথিত দোসর মানেই অভ্যুত্থানের উদ্যোক্তাদের কাছে বধযোগ্য, তাই মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো রক্ষার চেষ্টাকারী যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনই হামলার শিকার হচ্ছে। 

এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির কারণে এখন বিরোধী দল বা শক্তি বলে কিছু নেই। সবাই বর্তমান সরকারের সমর্থক। অথচ অসহনীয় দ্রব্যমূল্য, জানমালের নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি কারণে বিরোধী দলের চাহিদা জনপরিসরে দিন দিন বাড়ছে। সিপিবির ‘জাগরণ যাত্রা’ কর্মসূচি ছোট পরিসরে হলেও একটা বিরোধী স্বর তুলছে। এটাও ‘সমন্বয়ক’ কিংবা বিএনপি-জামায়াতের গাত্রদাহের কারণ?

এখন সিপিবি যদি তার এ মাঠের অবস্থানকে চাঙ্গা করে বা অন্তত ধরে রাখে, তা নিঃসন্দেহে অন্য বামদেরও উৎসাহিত করবে। হামলা-মামলা যতই হোক; এর মাধ্যমে বাম রাজনীতি সচেতন মানুষদের দৃষ্টি কাড়বে।

কেউ বলতে পারেন, এমন হামলার শিকার তো সিপিবি ও অন্যান্য বাম দল বিগত সরকারের আমলেও হয়েছে। তাহলে কেন সাম্প্রতিক হামলার ঘটনাগুলো এত তাৎপর্যপূর্ণ হবে? জবাবে শুধু এটা বলাই যথেষ্ট, বামপন্থিরা আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে ধারাবাহিক আক্রমণ করলেও মাঠের কর্মসূচিতে খুব একটা ধারাবাহিক ছিল না। 

স্বীকার্য, দেশের বাম দলগুলো নানা কারণে ইতোমধ্যে কয়েকবার ভেঙেছে; সিপিবির নেতৃত্বেও নানা টানাপোড়েন আছে। তার সঙ্গে আছে সমাজতন্ত্রের বৈশ্বিক বিপর্যয়। ফলে বাম আন্দোলনের সেই ষাট বা সত্তরের দশকের জৌলুস এখন নেই। ইতোমধ্যে জনপ্রিয় অনেক বাম নেতার স্খলন হয়েছে, এটাও ঠিক। তা সত্ত্বেও বিশেষত সততা ও আদর্শ-নিষ্ঠার কারণে সচেতন মহলে বাম নেতাকর্মীর আলাদা একটা মূল্য আছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে পরস্পর প্রতিপক্ষ দলগুলো বামপন্থিদের নিজ শিবিরভুক্ত করার চেষ্টা তো আর এমনি এমনি করে না। 

বামপন্থিরা যদি এখনও সঠিক ইস্যু বেছে নিয়ে মাঠের রাজনীতিতে ধারাবাহিক হয়; অন্তত তাদের লাল পতাকা অন্যদের ‘অধিকারে’ যাবে না।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews