‘ভালোবাসবো ভাসবোরে বন্ধু তোমায় যতনে, আমার মনের ঘরে চান্দের আলো চুইয়া চুইয়া পড়ে’, জনপ্রিয় ‘হৃদয়ের কথা’ ছবির এ গানটির দৃশ্যায়ন নিয়ে মজার একটি স্মৃতিকথা জানালেন নির্মাতা এস এ হক অলিক। তিনি ভাবনার সাগরে ডুব দিয়ে বলেন, ঠিক করলাম রাঙামাটির প্যাদা টিং টিং নামক স্থানে আমরা এ গানের শুট করব। কিন্তু যেদিন টিম নিয়ে সেখানে গেলাম দেখলাম গাছগাছালি বেড়ে ওঠে রীতিমতো জঙ্গলে পরিণত হয়েছে জায়গাটি। শুটিং করার মতো কোনো অবস্থা নেই। চরম টেনশনে পড়ে গেলাম। হঠাৎ নায়ক রিয়াজ চিৎকার করে বলে উঠল অলিক ভাই ওই যে দেখেন একটি ঝরনা। আমরা সেখানে তো এ গানের শুটিং করতে পারি। তারপর আমরা সেখানেই শুটিং করলাম। সেই ঝরনাটি এখন আর নেই। হৃদয়ের কথা-ই একমাত্র ছবি যার শুটিং সেখানে হয়েছিল। সেখানে কাজ করতে গিয়ে আরেকটি বিপত্তি ঘটেছিল। ঝরনার নিচে তিনটি পাথর ছিল। রিয়াজ ও পূর্ণিমা সেই পাথরের ওপরে বসবে এবং পূর্ণিমার বুকে রিয়াজ মাথা রাখবে। কিন্তু পাথরগুলো এতই পিচ্ছিল ছিল যে, পূর্ণিমা কোনোভাবেই সেই পাথরের ওপর বসতে পারছিল না। তখন রিয়াজ তার পরনে থাকা গেঞ্জি খুলে পাথরের ওপর বিছিয়ে দিল, আর পূর্ণিমা তার ওপর বসার পরে দৃশ্যায়ন সম্পন্ন হলো। নির্মাতা বলেন, মজার কথা হলো- দর্শক বুঝতেই পারল না যে, পূর্ণিমা গেঞ্জির ওপর বসা। তিনি বলেন, ছবি নির্মাণকালীন এমন অনেক ঘটনা থেকে যায় যেটি দর্শক জানতে পারে না। অলিকের কথায় ছবিটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে এতটাই দর্শক আগ্রহ তৈরি হলো যে, সিনেমা হলগুলো শো বাড়াতে বাধ্য হয়। স্টার সিনেপ্লেক্স একটি স্ক্রিনে প্রদর্শনের জন্য ছবিটি নেয়। কিন্তু দর্শকের চাপে ফোন করে জানায় আরও দুটি প্রিন্ট দিতে হবে। তখন ৩৫ মিলিমিটারে নেগিটিভে ছবির প্রিন্ট করা হতো। শেষ পর্যন্ত প্রিন্ট দিতে না পারায় তারা ওই একটি প্রিন্ট দিয়েই তিনটি স্ক্রিনে ছবিটি প্রদর্শন করে। বাংলা চলচ্চিত্রের সুন্দরতম রোমান্টিক সিনেমার একটি হলো ‘হৃদয়ের কথা’।
রিয়াজ-পূর্ণিমা অভিনীত এ সিনেমাটির নির্মাণ ছিল যুগের চেয়ে এগিয়ে।
বিশেষ করে সিনেমার দুটি গান ‘ভালো বাসবো বাসবোরে বন্ধু তোমায় যতনে’ এবং ‘যায় দিন যায় একাকী’ এখনো সমান জনপ্রিয়। এ গানগুলো শোনেনি এমন মানুষ দেশে পাওয়া যাবে না। সবকিছু মিলিয়ে সুন্দর একটি রোমান্টিক গল্প ও গানের সিনেমা ‘হৃদয়ের কথা’। অশ্লীলতা, কুরুচিপূর্ণ কাটপিস যখন আঁকড়ে ধরেছিল এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে, তখন রুচিশীল-শিক্ষিত দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সিনেমা হল থেকে। সেই সময়টাতে আশীর্বাদের ডাক নিয়ে এলেন পরিচালক এস এ হক অলিক। তিনি নির্মাণ করলেন ‘হৃদয়ের কথা’ ছবিটি। এর প্রযোজনাও করেছিলেন চিত্রনায়ক রিয়াজ। সময়টা ২০০৬ সাল। সেই বছরের ১৮ আগস্ট মুক্তি পেল এটি।
মৌলিক গল্প, রোমান্টিক আমেজ, জনপ্রিয় জুটির নান্দনিক অভিনয়, শ্রুতিমধুর সব গান, নির্মাণের মুন্সিয়ানায় ‘হৃদয়ের কথা’ চমকে দিল ইন্ডাস্ট্রিকে। সব শ্রেণির মানুষ হলে ফিরল উৎসব আমেজে। বিশেষ করে বাংলা গানের ভুবনে তখন ভীষণ খরা। আধুনিক গানের যে জনপ্রিয়তা সেটি প্রায় হারাতে বসেছিল।
ফিতার ক্যাসেট ছেড়ে সিডিতে ধাবমান হওয়া ইন্ডাস্ট্রি ভুগছিল নতুন কিছু গ্রহণের সিদ্ধান্তহীনতায়। সেই সময়টাতে হাবিব ওয়াহিদ যেন জাদুর পরশ নিয়ে এলেন ‘হৃদয়ের কথা’ ছবিতে ‘ভালোবাসবো বাসবোরে বন্ধু’ গানটি নিয়ে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের কাছে তো বটেই, ভিন্ন আমেজ আর হৃদয়ছোঁয়া সুরের কাছে মন সঁপেছিলেন সব বয়সের শ্রোতাই। তখন প্রায় সবখানেই বেজেছে এ গানটি। পাশাপাশি এস আই টুটুলের কণ্ঠে ‘যায় দিন যায় একাকী’ গানটিও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
মনির খান ও কনকচাঁপার কণ্ঠে ‘কতটা বছর এই সুখ রবে গো’-তেও ছিল অন্যরকম আবেদন। এ গানগুলো বাংলা ছবির গানে নতুন মাত্রা যোগ করে দিল। বাংলা সিনেমার গান ফিরল আবার মধ্যবিত্তদের অন্দরমহলে। হাবিব ওয়াহিদ ‘ভালোবাসবো ভাসবোরে’ গানটি দিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গেলেন। অন্যদিকে ‘যায় দিন যায় একাকী’ গানটি এস আই টুটুলকে দর্শকপ্রিয়তার নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। ছবির নির্মাতা এস এ হক অলিক জানান, যারা এ ছবির গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল যার যার কাজ ভালো করার। আর সেই চিন্তা থেকেই দীর্ঘ খরার পর বাংলা ছবির দর্শক পেল অসাধারণ কিছু গান।