মন্দার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে বেসরকারি খাত। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের বড় উদাহরণ দেশের অন্যতম বড় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান মোস্তফা কামাল। দেশের প্রতি দুই পরিবারের একটিতে কেনা হয় ফ্রেশ ব্র্যান্ডের পণ্য, যার প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল। যিনি পরিচিতি লাভ করেছেন ‘আইকনিক বিজনেস লিডার’ হিসেবেও।

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ৫৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের পণ্যসামগ্রীর তালিকায় রয়েছে ড্রিংকিং ওয়াটার, ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, সুজি, চিনি, গুঁড়াদুধ, কনডেন্সড মিল্ক, লবণ, চা, মসলা ইত্যাদি। এর বাইরে বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল, কেমিক্যাল, শিপিং, পাল্প অ্যান্ড পেপার, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ অনেক বড় বড় খাত ও ভারী শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ পিভিসি ও পিইটি রেজিন তৈরির শিল্পকারখানা মেঘনা পিভিসি লিমিটেডের পণ্য রপ্তানিও শুরু করেছে এমজিআই। এছাড়া খাদ্যপণ্য, রাসায়নিক, ভোজ্যতেল, প্রাণিখাদ্য, সিমেন্ট ও ব্যাগ রপ্তানি করছে। বিশ্বের ৩৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে এমজিআই-এর পণ্য। এ শিল্পগোষ্ঠীতে রয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মীর বাহিনী।

মোস্তফা কামাল এই মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরের একজন অগ্রণী শিল্পপতি। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারী অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম আলোর তথ্য মতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৪ হাজার কোটি টাকার আমদানি নিয়ে দেশের শীর্ষ আমদানিকারক ছিল।

বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম (বিবিএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ সি-স্যুট অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ অনুষ্ঠানের স্পেশাল ক্যাটাগরি ‘আইকনিক বিজনেস লিডার’-এর সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই)-এর চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোস্তফা কামাল।

দেশের বেসরকারি সংবাদ পত্র ‘কালের কণ্ঠ’র এক প্রতিবেদনে উঠে আসে তার শুরুর গল্পে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, লবণ বিক্রেতা থেকে মেঘনা গ্রুপের মালিক মোস্তফা কামাল! একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার পেছনে একটি গল্প থাকে। তেমনি এক গল্প হলো এটি। অথবা তারও কিছু বেশি। এই গল্প রূপকথাকে হার মানানো এক অপ্রতিরোধ্য কিশোরের জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প।

মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৫৫ সালে, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কন্কা পৈত গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে। বাবা ছিলেন সাধারণ সরকারি চাকুরে। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুটির লেখাপড়ায় হাতেখড়ি গ্রামেরই এক পাঠশালায়।মোস্তফা কামাল নিজ গ্রামের হাইস্কুলে পাঠশেষে ভর্তি হলেন বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরের একটি কলেজে।

এতটা পথ প্রতিদিন হেঁটে যেতে-আসতে প্রায়ই থমকে যেত কিশোর কামালের পা দু-খানা-প্রয়োজন একটি সাইকেলের। ক্লান্ত শরীরে প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা কষ্টসাধ্য হয়ে যেত। সদ্য অবসরে যাওয়া বাবার পক্ষে তার এই সাইকেলের আবদারটি পূরণ করা সম্ভব হলো না। অনেকটা অভিমান করেই ঘর ছাড়লেন কিশোর মোস্তফা কামাল।

তখন কে জানত তার এই অনিশ্চিত যাত্রাই একদিন পরিণত হবে স্বপ্নযাত্রায়! মোস্তফা কামাল চলে এলেন ঢাকায়। গুলিস্তানের ট্রাফিক ব্যারাকে থাকা তার এক ভাইয়ের কাছে উঠলেন প্রথমে। কিছুদিন এখানে থাকার পর যাত্রাবাড়ীতে একটা লজিং-এ থাকার ব্যবস্থা করেন। এরই মধ্যে তিনি একটি চাকরি জোগাড় করে ফেললেন, হাজী মুহাম্মদ হোসেন সাহেবের চকবাজারস্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।

তার বেতন মাসে ১৭৫ টাকা। যাত্রাবাড়ী থেকে প্রতিদিন বাসে করে আসতেন গুলিস্তান, খরচ চার আনা। তারপর গুলিস্তান থেকে হেঁটে কর্মস্থলে পৌঁছাতে হতো, যা ছিল খুবই কষ্টকর। তাই, পুনরায় লজিংয়ের ব্যবস্থা করলেন পুরান ঢাকার বেগম বাজারের এক বাসায়। নানান চড়াই-উৎরাই-এর মাঝেই চলতে থাকে তার ব্যবসার প্রস্তুতিকাল।

শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এই অদম্য মানুষটি ঠিকই তার জীবিকা-যুদ্ধের পাশাপাশি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে সক্ষম হন। ব্যবসার প্রেরণা কিন্তু পান অনেক আগেই, চাচার কাছ থেকে। গ্রামের সাপ্তাহিক হাটে তার চাচা সুপারির ব্যবসা করতেন। মোস্তফা কামাল বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় চাচার সুপারির ব্যবসায় সময় দিতেন। সেখান থেকেই ব্যবসার প্রতি তার ঝোঁক সৃষ্টি হয় বলে জানান তিনি।

টংদোকানে কামাল ট্রেডিং

মোস্তফা কামাল প্রথম ট্রেড লাইসেন্স করে ব্যবসা শুরু করেন ১৯৭৬ সালে। নাম ছিল কামাল ট্রেডিং। তখন তার এক পরিচিতজন শেরেবাংলা নগরে হাসপাতালে ছোট চাকরি করতেন। ফাঁকে ফাঁকে টংদোকান চালাতেন। ওই দোকানের ঠিকানায় ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন করলেন মোস্তফা কামাল।

পুরান ঢাকায় দোকানে চাকরি করার সময় মহাজন প্রায়ই তাকে ঢাকা ভেজিটেবলে পাঠাতেন। মোস্তফা কামাল ট্রেড লাইসেন্স করে ঢাকা ভেজিটেবলে এক কর্মকর্তার কাছে গিয়ে বললেন, ভাইয়ের দোকানে একটি সাব-ডিলার দেওয়া যায় কি না। এক কর্মকর্তা গেলেন পরিদর্শনে। তাকে অনুরোধ করে টং দোকানের জায়গায় শুধু দোকান লিখে প্রতিবেদন জমার ব্যবস্থা করলেন।

মোস্তফা কামাল বলেন, সাব-ডিলার হওয়াটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। মাসে ১৭৫ টাকা বেতনে চাকরি করতাম। নতুন ব্যবসায় মাসে আয় দাঁড়াল দুই থেকে তিন হাজার টাকা।

একপর্যায়ে নিজের জমানো টাকার সঙ্গে বাড়ি থেকে জমি বন্ধক দিয়ে কিছু টাকা এনে কসকো সাবানকে পণ্য সরবরাহ শুরু করলেন। একসময় মৌলভীবাজারে যৌথ অংশীদারত্বে দোকান দিলেন। ছোট ভাইকে সেখানে বসালেন। এটা আশির দশকের শুরুর দিকের ঘটনা। একটা পর্যায়ে মোস্তফা কামালের মাথায় পণ্য আমদানির চিন্তা ঢুকল। বললেন, আমার বিপদের শুরু হলো। পাম তেল আমদানির ঋণপত্র খুললাম। কিন্তু পণ্য দিল নিম্নমানের, তবে খাওয়ার অযোগ্য না।

পণ্য খালাস করতে বন্দরে বাড়তি টাকা চাইল। মোস্তফা কামাল দিতে পারলেন না। এর মধ্যেই আবার সামরিক শাসনের শুরু। প্রায় দু’বছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নথি ঘোরার পর তেল খালাসের অনুমতি পেলেন মোস্তফা কামাল। খরচের তিন ভাগের এক ভাগ দামে তেল বিক্রি করে দিলেন সাবান তৈরির কারখানায়। এখন ব্যাংকের টাকা দেবেন কীভাবে? মোস্তফা কামাল বলেন, ‘তখন ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার চিন্তাও কেউ করত না। আমি ব্যাংকে গিয়ে বললাম, অন্য কেউ হলে মাল খালাস করত না। আমি বেকুব, তাই করেছি। এখন সুদ মাফ করে কিস্তির ব্যবস্থা করে দেন। ব্যাংক সুযোগ দিল। ধীরে ধীরে আয় করে ব্যাংকের টাকা শোধ করে দিলেন।

শিল্পায়নে আত্মনিয়োগ

১৯৮৯ সালে মেঘনা গ্রুপ প্রথম যে শিল্পে হাত দেয় তা ছিল ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনারি। শুরুটা ছিল খুবই ছোট পরিসরে। নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাট ঘেঁষে গড়ে ওঠা সেই ছোট পরিসর বৃহৎ হতে খুব বেশি সময় নেয়নি। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০টির অধিক শিল্প-প্রতিষ্ঠানে।

প্রায় ৫০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই শিল্পাঞ্চলে উত্পাদিত হয় নানা ধরনের পণ্যসামগ্রী। দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে বড় অংশীদার মেঘনা গ্রুপ। তাদের পণ্য তালিকায় রয়েছে- মিনারেল ওয়াটার, ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, সুজি, চিনি, গুঁড়াদুধ, কনডেন্সড মিল্ক, লবণ, চা, মসলা ইত্যাদি।

শুধু ভোগ্যপণ্যের বড় অংশীদার হিসেবেই যে মেঘনা গ্রুপের অবস্থান তা নয়, এর বাইরে অনেক বড় বড় খাত ও ভারী শিল্পে বিনিয়োগকারী বা অংশীদারও এই গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মধ্যে রয়েছে- সিমেন্ট, কাগজ, পণ্যবাহী জাহাজ, শিপ বিল্ডিং, বিদ্যুৎ উৎপাদন, এভিয়েশন, স্টিল, আর্থিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে মোস্তফা কামালের পরিবার। মোস্তফা কামাল নিজে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। স্ত্রী বিউটি আক্তার ভাইস চেয়ারম্যান। বড় মেয়ে তাহমিনা মোস্তফা নিত্যব্যবহার্য পণ্য বা এফএমসিজি এবং মেজ মেয়ে তানজিমা মোস্তফা আন্তর্জাতিক ক্রয় ও সিমেন্ট ব্যবসা দেখাশোনা করেন। ছেলে তানভীর মোস্তফার দায়িত্বে রয়েছে প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তির দিকটি। ছোট মেয়ে তাসনীম মোস্তফা পরিচালক পদে রয়েছেন। তবে তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews