নানা চরাই-উৎড়াই পেরিয়ে ১৯৩২ সালে আধুনিক সৌদি আরবের গোড়াপত্তন করেন ইবনে সৌদ তথা আব্দুল আজিজ ইবনে সৌদ। প্রথা অনুযায়ী, সৌদি আরবে কোনো বাদশাহর মৃত্যুর পর যুবরাজ তথা ক্রাউন প্রিন্স তার স্থলাভিষিক্ত হন। এরপর ইবনে সৌদের ছেলেদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে একজন নতুন যুবরাজ নিয়োগ করা হয়। এছাড়া ক্ষমতা-কাঠামোর দ্বিতীয় সারিতে থাকেন একজন ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স। তবে সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় এই প্রথাকে বাইপাস করা হয়েছে। 

অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তী উত্তরাধিকার নির্ধারণের বেলায় নৈকট্য, আনুগত্য, অন্দরমহল তথা মাতৃতন্ত্রের প্রভাবসহ বিভিন্ন ফ্যাক্টরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সৌদি বাদশাহর পক্ষ থেকে একটি রাজকীয় ফরমান জারি করা হয়েছে, যেখানে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এ দেশটিতে ক্ষমতার কাঠামোতে কিছুটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত লক্ষ করা যাচ্ছে।

সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান গত ৪ আগস্ট একটি রাজকীয় আদেশ জারি করেছেন। এই ডিক্রি বা রাজকীয় আদেশের ফলে বাদশাহ সালমান এবং তার প্রধানমন্ত্রী ও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের অনুপস্থিতিতেই মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করা যাবে।

যতটা জানা যায়, এই ধরনের বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন মন্ত্রিসভার সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সদস্য। যিনি হবেন সৌদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সৌদের বংশধরদের কেউ।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই রাজকীয় আদেশ একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। কারণ ২০১৭ সালে মোহাম্মদ বিন সালমানকে যখন ক্রাউন প্রিন্সের পদে মনোনয়ন এবং তার ৫ বছর পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানো হয়েছিল, তখন থেকেই ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স এবং উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ খালি রয়েছে। অথচ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে এসব পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু সৌদি আরবের ডিসিশন-মেকিং স্ট্র্যাকচার বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাঠামোর কারণে এই শূন্যপদের জন্য রাজপরিবারের তৃতীয় শক্তিশালী ব্যক্তি কে হবেন- তা নিশ্চিত হওয়া বা সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে অনুমান করাও কঠিন হয়ে পড়ে।

সৌদি রাজত্বের মধ্যকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই একটি জটিল বিষয়। ১৯৬৪ সালে সৌদি রাজপরিবার এবং ধর্মীয় অভিজাত শ্রেণীর মধ্যকার পারস্পরিক চুক্তির কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন বাদশাহ সৌদ। তিনি ছিলেন আবদুল আজিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং সিংহসনের উত্তরাধিকারী।

মূলত নিজের ছেলেদের মধ্যে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রচেষ্টা, অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় ব্যয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির কারণে তার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে রাজপরিবার। এমনই প্রেক্ষাপটে বাদশাহ সৌদের সৎ ভাই ও ক্রাউন প্রিন্স ফয়সাল উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে একটি পারিবারিক জোট গঠন করতে বাধ্য হন।

কিং সৌদের অপসারণের পর রাজা হন ফয়সাল। তিনি একটি নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন, যেখানে ক্ষমতা বন্টন করা হয় আব্দুল আজিজের বিভিন্ন পুত্রদের মধ্যে, বিশেষ করে যারা তার অভ্যুত্থানের অংশীদার ছিলেন। অবশ্য এর উদ্দেশ্য ছিল- রাজত্বের ক্ষমতা যাতে রাজপরিবারের একটি উপবিভাগের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে না পড়ে।

ক্ষমতার এই সমান্তরাল বণ্টনের ফলে একটি প্রাতিষ্ঠানিক জমিদারি সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। অর্থাৎ যে রাজপুত্র যে সরকারি বিভাগ বা সংস্থার দায়িত্বে থাকেন, তিনি সেই বিভাগ বা সংস্থাকে ব্যক্তিগত রাজত্ব হিসেবে বিবেচনা করতে থাকেন। সেইসঙ্গে পৃষ্ঠপোষকতার নেটওয়ার্ক তথা নিজের সমর্থক-গোষ্ঠী গড়ে তোলার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধিতে এটি ব্যবহার করেন।

এর ফলে ধীরে ধীরে সৌদি রাজপরিবারের মধ্যে ক্ষমতার একটি শ্রেণিবিন্যাস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাদশাহ ও যুবরাজের বাইরে ৩০ জনের বেশি সৎ ভাইয়ের একটি গ্রুপ আবির্ভূত হয়। যারা তাদের জ্যেষ্ঠতা, মায়ের বংশধর এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় রাজনৈতিক গুরুত্বের ভিত্তিতে সৌদি সিংহাসনের ভবিষ্যত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে ভাবতে শুরু করেন।

এমনই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালে সৌদি কিংডমের দ্বিতীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান প্রিন্স ফাহাদ, যা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। সৌদি রাজতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী সাধারণত ক্রাউন প্রিন্স বা যুবরাজ প্রথম ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকেন। যাইহোক, সেই সময় একজন ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্সের তেমন কোনো সরকারি অবস্থান কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে রাজতন্ত্রে প্রবেশের আনুষ্ঠানিক কোনো প্রবেশপথ ছিল না।

কিন্তু প্রিন্স ফাহাদ ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ একদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার যেমন প্রভাব ও মর্যাদা ছিল, অন্যদিকে বাদশাহ আব্দুল আজিজের অন্যতম স্ত্রী হুসা বিনতে আহমেদ আল সুদাইরির ঘরের ৭ পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড়। এ কারণে তার সিংহাসনে উত্তরাধিকারী হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৮২ সালে তার বড় সৎ ভাই এবং বাদশাহ খালিদের মৃত্যুর পর সৌদি সিংহাসনে বসেন ফাহাদ।

এই ঘটনা ধারাবাহিকতাভাবে দ্বিতীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের প্রক্রিয়া সহজ করে দেয়। ফলে সুদাইরির ঘরের সাত পুত্রের মতো অন্যান্য পক্ষের ভাইদের মধ্যে পৃথক শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি হয়। আবার ক্ষমতাসীন বাদশাহ এবং প্রভাবশালী পরিবার-সমর্থিত আলাদা আলাদা গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়, যারা রাজতন্ত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

এক্ষেত্রে প্রিন্স আবদুল্লাহর বিষয়টি উল্লেখ করার মতো ঘটনা। তিনি ১৯৭৫ সালে দ্বিতীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিং সৌদের বিরুদ্ধে প্রিন্স ফয়সালের যে অভ্যুত্থান, তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন এই আবদুল্লাহ। তিনি ১৯৬২ সাল থেকে সৌদি আরবের ন্যাশনাল গার্ডের নেতৃত্বে ছিলেন। তাছাড়া শক্তিশালী শামার উপজাতির সাথেও তার মাতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক ছিল। অথচ অতীতে এই গোত্রটি সৌদি রাজপরিবারের রাজনৈতিক শত্রু ছিল।

আবদুল্লাহ ২০০৫ সালে বাদশাহ ফাহাদের মৃত্যুর পর সৌদি সিংহাসনে বসেন। এর ৯ বছর পর আরেক সৎ ভাই প্রিন্স মুকরিনকে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেন আব্দুল্লাহ। এর মাধ্যমে রাজকীয় উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে একটি নতুন ও আনুষ্ঠানিক সিস্টেম চালু করেন তিনি। পূর্বসূরীদের মতো মুকরিনও সৌদি গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে একটি প্রভাবশালী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। যদিও প্রাথমিকভাবে রাজার সাথে নৈকট্যের কারণেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু ২০১৫ সালে আবদুল্লাহ মারা যাওয়ার পর সৌদি সিংহাসনে আসীন হন বর্তমান বাদশাহ সালমান। ফলে বিগত কয়েক দশক ধরে যেখানে রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বিভিন্ন সৎ-ভাই ও তাদের নিজ নিজ মিত্রদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলে আসছিল সেটি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন হওয়ার দুই বছরের মধ্যে সালমান পর পর দুই ক্রাউন প্রিন্সকে অপসারণ করেন এবং তার নিজের ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমান তথা এমবিএস-কে সেই পদে বসান।

হস্তক্ষেপের এই বছরগুলিতে বাদশাহ সালমান এবং তার ছেলে এমবিএস ব্যাপকভাবে প্রশাসনিক পরিবর্তন এবং দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নাম করে প্রভাবশালী প্রিন্সদের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রভাব একবারে ধুলিস্যাৎ করতে সক্ষম হন।

নতুন এই ব্যবস্থায় সৌদি রাজবংশের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে বাদশাহ ও তার ছেলের বিশেষ অধিকারে পরিণত হয়। যা সৌদি বাদশাহর অবস্থানকে প্রথমবারের মতো সমান্তরাল থেকে আল্টিমেট ইম্পেরিয়াম তথা চূড়ান্ত সার্বভৌমে পৌঁছে দেয়।

তবে সম্প্রতি কিং আবদুল আজিজের জ্যেষ্ঠ বংশধরদের মন্ত্রিসভা অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার অনুমতি দিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে; তার মাধ্যমে বাদশাহ এবং ক্রাউন প্রিন্সের বাইরে ক্ষমতার বর্তমান রাজকীয় শ্রেণিবিন্যাসের একটি আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

মন্ত্রিসভায় রাজপরিবারের দুই সিনিয়র সদস্য অর্থাৎ প্রিন্স মানসুর বিন মিতেব এবং বর্তমান বাদশাহর আরেক পুত্র প্রিন্স আব্দুল আজিজ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স এমবিএসের চেয়ে অনেক বড়। তার মানে হলো- ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্সের পদে এই দুইজনের ভবিষ্যত প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

সুতরাং ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্সের পদে প্রকৃত প্রার্থীরা হলেন- রাজপরিবারের অবশিষ্ট পাঁচ তরুণ, যারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। এর মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী যুবরাজ খালিদ বিন সালমান ব্যতীত কেউই তাদের পিতার সূত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মন্ত্রণালয়ের উত্তরাধিকারী হননি। প্রিন্স খালিদ বাদশাহ সালমানের কনিষ্ঠ পুত্রদের মধ্যে একজন।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রাজপরিবারের মধ্যে ক্ষমতার শ্রেণিবিন্যাস পরিবর্তিত হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি এবং বাদশাহ ও ক্রাউন প্রিন্সের মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং নৈকট্য এখন রাজ্যত্বের পেকিং অর্ডার (ক্ষমতা বা পদের শ্রেণিকরণ) পলিসির মধ্যে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করে থাকে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews