স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভারতের পার্লামেন্ট নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নির্বাচনি বন্ড চালু করেন দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। নির্বাচন কমিশনকে চাপ দিয়ে কোন দল কত টাকা পেয়েছে, তা বের করেছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। সেই তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারে অধিষ্ঠিত বিজেপিই প্রথম হয়েছে। তারা প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গের দিদি মমতা ব্যানার্জি পেয়েছেন দ্বিতীয় স্থান। তৃতীয় স্থানে রয়েছে সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস। ছোটখাটো আঞ্চলিক দলগুলো কিছু কিছু পেয়েছে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন বাধ্য হয়েছে সম্পূর্ণ তালিকাটি প্রকাশ করতে। এ তথ্য পাওয়ার পর সারা ভারতে কার্যত ঝড় উঠেছে। নির্বাচন কমিশন তথ্য অনুযায়ী ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলগুলো প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই নয়। অর্থমন্ত্রীর স্বামী, যিনি নিজেও একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, পরকলা প্রভাকর এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, বিশ্বের বৃহত্তম দুর্নীতি হলো নির্বাচনি বন্ড। এদিকে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের একটি মন্তব্যও চাঞ্চল্য তৈরি করেছে ভারতের রাজনৈতিক মহলে। তিনি মন্তব্য করেছেন, আমাকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে লড়াই করার মতো টাকা আমার কাছে নেই। তাই আমি ভোটে দাঁড়াব না।তার এ মন্তব্য শুনে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্মলা প্রথমত, দেশের অর্থমন্ত্রী, তথা বিজেপির প্রথম সারির নেতা। দ্বিতীয়ত, তার দল বিজেপি নির্বাচনি বন্ডে সব থেকে বেশি টাকা সংগ্রহ করেছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কেন নির্মলা নির্বাচনে না দাঁড়ানোর জন্য টাকার অভাব প্রসঙ্গ তুলছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের একটা বড় অংশ কিন্তু মনে করছেন, নির্মলা ঘুরপথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেই বার্তা দিতে চাইলেন। জওহর লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, অর্থনীতিবিদ নির্মলা হয়তো বলতে চাইলেন যে নির্বাচনি বন্ডের টাকা নিয়ে দেশ-বিদেশে এত প্রশ্ন উঠেছে, সেই টাকা দিয়ে তিনি নির্বাচন করবেন না। তবে শেষ পর্যন্ত বিজেপির হয়ে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে নির্মলা সীতারমনের এই মন্তব্য যে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্বকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য, নির্মলার ওই মন্তব্য নিয়ে ওই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিজেপির শীর্ষ মহল থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি আরএসএসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকেও। নরেন্দ্র মোদির চালু করা নির্বাচনি বন্ডকে বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারি বলে ব্যাখ্যা করেছেন নির্মলা সীতারমনের স্বামী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তথা অন্ধ্রপ্রদেশের কংগ্রেস নেতা পরকলা প্রভাকর।
তিনি এর আগেও একাধিকবার মোদি সরকার এবং তার মন্ত্রীর অর্থমন্ত্রকের বিভিন্ন নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ভারতের লোকসভা নির্বাচনের একেবারে দোরগোড়ায় বিজেপি যখন নির্বাচনি বন্ড থেকে নজর ঘোরাতে চাইছে, তখন প্রভাকর তাকে বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারির তকমা দিয়ে মোদি সরকার তথা বিজেপিকে বিপাকে ফেলেছেন। কারণ, এতদিন বিরোধী শিবির থেকে নির্বাচনে স্বচ্ছতার পক্ষে আন্দোলনকারীরা ঠিক এই অভিযোগই তুলে ধরছিলেন। প্রভাকরের মতে, নির্বাচনি বন্ড নিয়ে এখন যা হইচই হচ্ছে, আগামী দিনে আরও বেশি হইচই হবে। তার ফলে নির্বাচন বিজেপি বনাম আমজনতার লড়াই হয়ে উঠবে। ভোটটা আর তখন বিজেপি বনাম বিরোধী জোটের থাকবে না। গোপনে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দেওয়ার জন্য মোদি সরকারই নির্বাচনি বন্ড ব্যবস্থা চালু করেছিল। অরুণ জেটলি অর্থমন্ত্রী থাকার সময় এ প্রকল্প চালু হয়।
সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দিয়ে সব তথ্য প্রকাশের নির্দেশ দেওয়ার পর দেখা গেছে কেন্দ্রের শাসক দল হিসেবে নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া চাঁদার অর্ধেক অর্থই বিজেপির কোষাগারে গেছে। যেসব করপোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই ইডির তদন্ত চলছিল, সেই সংস্থাগুলো বিজেপিকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে। বহু সংস্থা বিজেপিকে চাঁদা দেওয়ার আগে বা পরে কোটি কোটি টাকার সরকারি প্রকল্পের বরাত পেয়েছে। বিরোধীরা এ কারণেই একে আর্থিক কেলেঙ্কারির তকমা দিয়েছে।
এ তথ্য প্রকাশের পর নির্মলা সীতারমন বলেছিলেন, পুরোপুরি আন্দাজে ইডির হানার সঙ্গে বিজেপিকে চাঁদা দেওয়ার যোগসূত্র টানা হচ্ছে। একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী পদে তার পূর্বসূরি অরুণ জেটলিকে উদ্ধৃত করে সীতারমন বলেছিলেন, আগে নগদে চাঁদা দেওয়ার ব্যবস্থা থেকে নির্বাচনি বন্ড ব্যবস্থা ভালো ছিল। কারণ এখানে টাকা একজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে রাজনৈতিক দলের অ্যাকাউন্টে যাচ্ছিল।
কিন্তু তার স্বামী প্রভাকর বলছেন, মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, নির্বাচনি বন্ড শুধু দেশের সব থেকে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। তার জন্য বিজেপি ভোটারদের থেকে কঠোর শাস্তি পাবে।
আবহাওয়ার পারদ যত দ্রুত বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপের পারদ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজনৈতিক নেতাদের পরস্পরের প্রতি কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ। নির্বাচন কমিশন সব দলকে অসাংবিধানিক ভাষা প্রয়োগ না করার নির্দেশ দিয়েছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই এ নির্দেশ মানছেন না। নির্বাচন কমিশন এখনো পর্যন্ত তাকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি।
সরকারিভাবে নরেন্দ্র মোদি ৩১ মার্চ উত্তরপ্রদেশের মিরাট থেকে তার প্রচার শুরু করবেন। মিরাটে বিজেপির প্রার্থী হলেন প্রাক্তন অভিনেতা অরুণ সোভিল। উল্লেখ্য, ভারতে একদা অত্যন্ত লোকপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘রামায়ণ’ ধারাবাহিকে রামের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এই সোভিল। সেই ধারাবাহিকে সীতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দীপিকা চিকলিয়া। তাকেও বিজেপি গত নির্বাচনে দলের প্রার্থী করেছিল। তিনি গুজরাট থেকে জিতেও ছিলেন। কিন্তু এখন আর তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে নেই।
নির্বাচনের উসিলায় মোদি সরকার যেভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে, সরাসরি তার কঠোর সমালোচনা করেছে আমেরিকা, জার্মানি এবং জাতিসংঘ। ভারতের বিদেশমন্ত্রকের তরফে সতর্ক করার পর তারা আবারও ভারতের শাসক দলের নিন্দা করেছে।
লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক