বাংলাদেশের রাজনীতির পটভূমিতে ছাত্ররাজনীতি বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনের মূল ভূমিকায় ছিলো শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অবদানের বারংবার পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রশিবির একটি বিতর্কিত নাম হলেও বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় সংগঠনটি। শিক্ষার্থীদের মাঝে সাংগঠনিক দক্ষতা, ত্যাগ, নৈতিকতা ও আদর্শ চর্চার কারণে ছাত্রশিবির একটি শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে দীর্ঘকাল। বিশেষ করে সংগঠনটি সাম্প্রতিক সময়ে যে ব্যতিক্রমধর্মী কার্যক্রমে নিজেদের নিয়োজিত করেছে—তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে নতুন আলোচনা ও জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন জাগে: ছাত্রশিবিরের এই মানবিক কর্মকাণ্ড ও ছাত্রকল্যাণমূলক উদ্যোগ কি জামায়াতকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে জনসমর্থন আদায়ে সহায়তা করতে পারবে।

২০২৫ সালের কোরবানির ঈদে ছাত্রশিবিরের ব্যতিক্রমী কর্মসূচি দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সংগঠনের অনেক শাখার নেতৃবৃন্দ নিজেদের ব্যক্তিগত ঈদ আনন্দ বিসর্জন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কোরবানি করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছে। এই কর্মকাণ্ডে শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীই নয়, ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। ছাত্রশিবিরের এই পরিবর্তন, যেখানে সংগঠনটি তার ‘আদর্শ চর্চা’কে মানবিকতায় রূপান্তর করছে, তা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ, তরুণ সমাজে যারা রাজনীতি বিমুখ, তারাও এ ধরনের সহমর্মিতার উদাহরণে আকৃষ্ট হয়।

শুধু কোরবানির কর্মসূচি নয়, ছাত্রশিবির ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কল্যাণমূলক ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যেমন:শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, শীতবস্ত্র ও খাদ্য সহায়তা প্রদান, বিজ্ঞান মেলা, বৃক্ষরোপণ, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেশন, কমিউনিটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। 

এসব কর্মসূচি তরুণদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি একটি সংগঠিত, সুশৃঙ্খল, দায়িত্বশীল ছাত্রসংগঠনের চিত্র তুলে ধরছে। এ যেন ছাত্ররাজনীতিকে সংঘাত ও সহিংসতার গণ্ডি থেকে বের করে এক ‘কমিউনিটি সার্ভিস’-ভিত্তিক নতুন মডেলে রূপান্তরিত করছে।

ভোটের মাঠে কতটুকু প্রভাব রাখবে এসব কর্মসূচি? এ প্রশ্নটি এখন সময়োপযোগী এবং গভীর বিশ্লেষণ দাবি করে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক পুনঃউত্থানের আলামত স্পষ্ট। দলটি ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ভাবছে, যদিও রাজনৈতিক বাস্তবতা এখনো তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। এই পরিস্থিতিতে ছাত্রশিবিরের তৃণমূল পর্যায়ের ত্যাগ, নিষ্ঠা ও জনসম্পৃক্ততা কি আদৌ জামায়াতকে নির্বাচনী মাঠে সাহায্য করতে পারবে?

আমার মতে, হ্যাঁ—শর্তসাপেক্ষে। কারণ, জামায়াতের ভোটব্যাংক ঐতিহাসিকভাবেই সুসংগঠিত এবং বর্তমানে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের শাখা-প্রশাখা দেশের সব অঞ্চলেই সক্রিয়। এই কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত তার ভোটব্যাংক পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে ছাত্রদের মাধ্যমে পরিবারের ওপর প্রভাব বিস্তার এবং স্থানীয় পর্যায়ে আস্থা অর্জনের কৌশলে বেশি মনোযোগী হচ্ছে।

তবে ছাত্রশিবির ও জামায়াতের অতীত ইতিহাসও জনগণের মননে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকা তাদের প্রতি আজও একটি সন্দেহবাতিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে রেখেছে। এই অবস্থায় শুধুমাত্র কিছু মানবিক কর্মসূচি দিয়ে সেই দেয়াল ভাঙা হয়তো সহজ হবে না। প্রয়োজন হবে দীর্ঘস্থায়ী ও দৃশ্যমান ইতিবাচক পরিবর্তনের।

আজকের তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিকে দেখতে চায় যুক্তি, মানবতা, পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায়ের কনটেক্সটে। ছাত্রশিবির যদি আধুনিক চিন্তাচর্চা, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা, আন্তঃসাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতা ও উদার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে মনোযোগ দেয়—তাহলে ভবিষ্যতে তারা জামায়াতকে নতুন প্রজন্মের গ্রহণযোগ্য দল হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।

ছাত্রশিবিরের উচিত হবে তাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য নতুন মডেলের ছাত্ররাজনীতি তৈরি করা, যেখানে সহিংসতা নয়, থাকবে সহমর্মিতা ও সমাধানের কৌশল।

ছাত্রশিবিরের ব্যতিক্রমী ও মানবিক কার্যক্রম নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়। এটি শুধুমাত্র একটি ছাত্রসংগঠনের নতুন রূপই নয়, বরং জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি দলকে জনসম্পৃক্ত রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনাও তৈরি করছে। তবে এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে আন্তরিকতা, ধারাবাহিকতা, এবং আধুনিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার উপর।

জামায়াত যদি সত্যিই ছাত্রশিবিরের এই ইতিবাচক কর্মকাণ্ডকে শক্তি হিসেবে কাজে লাগাতে চায়, তাহলে দরকার হবে খোলামেলা রাজনৈতিক যোগাযোগ, স্বচ্ছতা,সমালোচনা গ্রহন করার মানসিকতা এবং আধুনিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি প্রতিশ্রুতি। তখনই হয়তো দেখা যাবে—ছাত্রশিবিরের কোরবানির মাংস বিতরণ,গণইফতার শুধু খাবার নয়, ভোটের মাঠের চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews