জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের সম্প্রতি বলেছেন, জাপা ও আওয়ামী লীগ দেশের মোট ভোটের ৫০% অংশীদার। তাই আওয়ামী লীগ ও জাপাকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্য হবে না। জি এম কাদেরের এ বক্তব্য সঠিক নয় বলে প-িতদের অভিমত। তাদের অভিমত হচ্ছে, জি এম কাদের জাপা ও আওয়ামী লীগের ভোটের যে হার দাবি করেছেন, সে হিসাবটা চোরতন্ত্র ও ডাকাততন্ত্রের সময়ের ভোটের হিসাব হতে পারে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ওই দু’টি দলের ভোটের হার মোট ভোটের ১০%ও হবে না। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নির্বাচনে জাপা এখন ২-৩টির বেশি আসনে জয়ী হতে পারবে না। তবে ভোট পাওয়ার আনুপাতিক হারে এমপি নির্ধারিত হওয়ার যে দাবি উঠেছে, সেটা হলে আওয়ামী লীগের এমপির সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে। উপরন্তু এই পদ্ধতিতে দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের কর্তৃত্ব ও দুর্নীতি বেড়ে যাবে। তাই বিদ্যমান ব্যবস্থাই শ্রেয়। যা’হোক, জাপা ও আওয়ামী লীগের ভোটের হার যেটাই হোক না কেন, সেটা জাতীয় ভোটেরই অংশ। স্মরণীয় যে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সমর্থনের বিষয়ে ইনকিলাব একটি জরিপ করেছে গত ২০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সে জরিপ রিপোর্ট মতে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে সমর্থনের হার বিএনপির ৬১.০৮%, জামায়াত ১৪.৮২%, নতুন কোনো দল হলে তার ৮.১১%, ইসলামপন্থীদের ৫.০৫%, আওয়ামী লীগ ২.৯৯%, বামপন্থীদের ০.১৯% এবং অন্যান্য ২.৯৮% বলে গত ১০ ডিসেম্বর দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশ। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জরিপ করা হলে প্রায় একই রেজাল্ট আসবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। সামান্য কিছু কম-বেশি হতে পারে, এই যা। যা’হোক, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছেন, যার অন্যতম হচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানো। তাতে ভারত সংশ্লিষ্ট হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। ত্রিপুরার আগরতলায় উগ্রপন্থী হিন্দুরা বাংলাদেশের দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ভারতের অন্য স্থানেও বাংলাদেশের পতাকা পুড়িয়েছে। বিজেপি নেতা ও তেলেঙ্গানার বিধায়ক টি রাজা সিং ৮ ডিসেম্বর এক জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশে বলেছেন, ‘১৫ মিনিটের জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিন, যাতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর যে ‘নির্যাতন’ চলছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে পরিস্থিতি পরিষ্কার (ক্লিয়ার) করতে পারি।’ তিনি মঞ্চে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাও ছিঁড়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘যারা ভারতের বিরুদ্ধে যাবে, তারা একই পরিণতির শিকার হবে, (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী গত ১০ ডিসেম্বর বলেছেন, বাংলাদেশের ‘বৈধ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবৈধ। সর্বোপরি ভারত বাংলাদেশে পণ্য রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। বেশির ভাগ মিডিয়া বিভিন্ন স্থানের সন্ত্রাসী কর্মের ছবি কাটিং করে পেস্ট করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার ছবি বলে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছে। কিন্তু তথ্য যাচাইকারী সংস্থা রিউমর স্ক্যানার গত ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর ও গুজব ছড়িয়েছে। এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমকে শনাক্ত করা হয়েছে । এভাবে বিভিন্ন নামে ফ্যাক্ট চেকারের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ বিরোধী ভারতের প্রচারণার বেশিরভাগই ভুয়া। উল্লেখ্য যে, হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃঞ্চ দাস এক রাষ্ট্রদোহ মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে ভারত ঐসব অপকর্ম করছে বাংলাদেশের হিন্দুদের রক্ষা করার নামে। অথচ, ভারত হচ্ছে সাম্প্রয়িক দাঙ্গা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রধান দেশ। বিজেপি ও তার সমমনা দলগুলো হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সাম্প্রদায়িক দল। তাই সেখানে অহরহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে। তাতে সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে নিহত-আহত হচ্ছে। সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে অনেক। সর্বোপরি ভারতে ঐতিহ্যবাহী স্থানের মুসলিম নাম বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদী নাম রাখা হচ্ছে। এসব আমেরিকার রিপোর্টেও বলা হয়েছে বহুবার। তাই ভারতের সংখ্যালঘুদের জানমাল রক্ষা করার জন্য সে দেশের সর্বত্রই জাতিসংঘের শান্তিবাহিনী মোতায়েন করা দরকার বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। যা’হোক, ভারত যে বাংলাদেশ বিরোধী যুদ্ধংদেহী মনোভাব গ্রহণ করেছে, তা বাংলাদেশের হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য নয়, তারা আতংক থেকেই এটা করছে। সে আতংক হচ্ছে, বাংলাদেশে ভারতের সেবাদাস সরকারের পতনের পর ভারত মনে করছে, প্রাপ্ত একতরফা ট্রানজিট চুক্তি বাতিল এবং আসামের উলফাদের ঘাঁটি বাংলাদেশে পুনরায় চালু হতে পারে। সে কারণেই ভারত চিন্তিত হয়ে বাংলাদেশবিরোধী কাজ করছে। কিন্তু এতে বাংলাদেশের চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে ভারতের। বাংলাদেশিরা ভারতে না যাওয়ার কারণে দেশটির ব্যবসা, পর্যটন, চিকিৎসা খাতে ধস নেমেছে। তাই এখন ভারতীয়রা আহাজারী করছে! দ্বিতীয়ত ভারত বড় আর্থিক, সামরিক শক্তির দেশ হওয়ায় পার্শ্ববর্তী ছোট ও দুর্বল দেশগুলোর উপর যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে তা সফল হবে না। এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের তালেবানের উদাহরণ স্মরণীয়। আমেরিকা ও ইউরোপ আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়ে দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু মাদরাসার শিক্ষার্থী তালেবানদের কাছে যুদ্ধে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়ে ব্যাপক সেনা ও যুদ্ধাস্ত্র ক্ষয় করে পাততাড়ি গুটিয়ে বিদায় নিয়েছে। অর্থাৎ দখলদাররা জাতীয় ঐক্য ও দেশপ্রেমের কাছে পরাজিত হয়েছে। একই অবস্থা হবে ভারতেরও, যার জ্বলন্ত প্রমাণ, কিছুদিন আগে ভারত বাধ্য হয়েছে মালদ্বীপের হুঁশিয়ারীর প্রেক্ষিতে সে দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে। অপরদিকে, বর্তমানে বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী নৈরাজ্য ও ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূস সম্প্রতি পরপর কয়েকদিন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার দোসর জাপা ছাড়া দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ডেকে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। তাতে সকলেই একবাক্যে বলেছে, জীবন দেব তবুও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের একবিন্দু ক্ষতি হতে দেব না। ফলে ভারতের আগ্রাসনবিরোধী সকলের সম্মিলিত গগনবিদারী আওয়াজ উঠেছে দেশব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে গত ৮ ডিসেম্বর বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা, মিডিয়ায় মিথ্যে প্রচারণা, সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদ এবং দেশে আগ্রাসনের অভিযোগে। তাই ভারত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ভারত-বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবদের সভায় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে কাজ করতে আগ্রহী। বিভিন্ন কারণে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি মেঘ এসেছে, সেই মেঘটি দূর করতে হবে। বাংলাদেশও বলেছে, এটি দূর করতে হবে। বিক্রম মিশ্রি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। হ্যাঁ, এটাই প্রতিবেশী দেশের নীতি হওয়া উচিত। সেই নীতিই বাংলাদেশ পালন করে আসছে স্বাধীনতাত্তোর থেকেই। কিন্তু ভারত চলেছে আধিপত্যশীল নীতি নিয়ে। ফলে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ ভারতবিরোধী হয়ে উঠেছে।

যা’হোক, ভারতের আগ্রাসনবিরোধী যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে। কারণ, এটা একটা বিরাট ও দুর্লভ শক্তি। তাই এই শক্তি দিয়ে শুধু ভারতীয় আগাসন ও পতিত ফ্যাসিস্টদের নৈরাজ্য মোকাবেলা করেই ক্ষান্ত হলে চলবে না, দেশের শান্তি ও উন্নতির চরম অন্তরায় যে আরো কিছু বিষয়ে আছে, সেগুলো অর্থাৎ দুর্নীতি, দখল, মূল্যস্ফীতি, মাদক, আয় বৈষম্য, অর্থ পাচার, বেকারত্ব, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নির্মূল এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও পতিত সরকারের সময়ের অপরাধের বিচার করতে হবে। সর্বোপরি প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব কাজ কোনো একক ব্যক্তি বা দলের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সে জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। এসব স্থায়ী করার জন্য বর্তমান সরকার ব্যাপক সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাতে সকলের সহায়তা করা দরকার। কারণ, ব্যাপকতর সংস্কার হলে প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সার্বিক শান্তি ও উন্নতির স্থায়ী পথ সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়ত, সংস্কার যত তাড়াতাড়ি শেষ হবে নির্বাচনের ব্যবস্থা তত তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হওয়ার পর জাতীয় সরকার গঠন করার কথা উঠেছে। অবশ্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও তো জাতীয় সরকারই। জাতীয়ভাবেই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, যার ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে সেটা হয়েছে অরাজনৈতিকভাবে, সাবেক আমলা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের লোকদের নিয়ে। এটা রাজনৈতিকভাবে করতে পারলে কল্যাণ হবে বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, এমন আলামত পাওয়া যাচ্ছে। স্মরণীয় যে, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল-বিএনপি ঘোষণা করেছে যে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। সেটা একটা ভালো প্রস্তাব। যা’হোক, ড. ইউনূসের উদ্যোগে দেশে যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে সেটা দেশে এক বিরল ঘটনা। তাই এটাকে ধরে রাখতে হবে এবং এই ঐক্যের মাধ্যমে দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দ্বিতীয়ত: দিল্লীস্থ ইউরোপের ১৯টি দেশের ও মিশনের দূতরা ড. ইউনূসের সাথে ঢাকায় এসে সাক্ষাৎ করে তার দায়িত্ব গ্রহণ এবং সংস্কারের উদ্যোগের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। এটাও এ দেশে এক বিরল ঘটনা এবং দেশের ও সরকারের জন্য মর্যাদাকর। পশ্চিমা কূটনীতিকদের এই সাক্ষাতের সময় বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাপক অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই মিস-ইনফরমেশন ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সহযোগিতা কামনা করেছেন এবং বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে সরিয়ে ঢাকায় অথবা প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশে স্থানান্তরের জন্য অনুরোধ করেছেন। স্মরণীয় যে, ইতোমধ্যেই বুলগেরিয়া বাংলাদেশিদের জন্য তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছে। তাই বাকী দেশগুলোর সেটা করতে অসুবিধা কোথায়?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews