জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আমৃত্যু কারাদণ্ডকে অপর্যাপ্ত বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। তার মতে, অপরাধের নৃশংসতা ও ব্যাপকতা বিবেচনায় এ মামলায় তাদের একমাত্র প্রাপ্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

গতকাল সোমবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি অভিযোগে দেয়া আমৃত্যু কারাদণ্ডকে মৃত্যুদণ্ডে উন্নীত করার দাবিতে রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছে। পাশাপাশি অন্য একটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, তা বহাল রাখার আবেদনও করা হয়েছে।

প্রসিকিউটর তামিম বলেন, গত ১৭ নভেম্বর পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে শেখ হাসিনা ও কামালকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে একটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং অপর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তবে যে অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, সেখানে অপরাধের ভয়াবহতা ও আইনের বিধান অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডই যথাযথ শাস্তি বলে রাষ্ট্রপক্ষ মনে করে।

তিনি জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী রায়ের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ দ্রুত আপিল দায়ের করেছে। আইনের বিধান অনুযায়ী, আপিল দায়েরের ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির কথা রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

নৃশংসতার বিবরণ দিতে গিয়ে গাজী এম এইচ তামিম বলেন, অভিযুক্তদের নির্দেশ বা উসকানিতে সারা দেশে এক হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ২৫ হাজারের বেশি। নিরস্ত্র ও নিরীহ জনগণের ওপর চালানো এই সহিংসতার মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, এ ধরনের গুরুতর অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডই প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

তিনি আরো বলেন, শাস্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধু আসামিদের অধিকার নয়, ভুক্তভোগী পরিবার এবং সমাজের ন্যায্য প্রত্যাশার বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া জরুরি। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত প্রয়োজন। প্রসিকিউটর তামিম জানান, রায় ঘোষণার পর থেকে আসামিরা পলাতক রয়েছেন এবং বিদেশে অবস্থান করে বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় তাদের প্রতি কোনো ধরনের অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই বলে রাষ্ট্রপক্ষ মনে করে।

আপিলে আনা আটটি গ্রাউন্ড

প্রসিকিউশন যে আটটি আইনি ও বাস্তবিক ভিত্তি (গ্রাউন্ড) দেখিয়ে আপিল করেছে, সেগুলো হলো-

১. আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এ শাস্তির বর্ণনায় প্রথমেই মৃত্যুদণ্ডের কথা উল্লেখ আছে, এরপর অপরাধের ভয়াবহতা (গ্র্যাভিটি অব দ্য অফেন্স) বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। যেহেতু আইনে মৃত্যুদণ্ড একটি সুস্পষ্ট বিধান, তাই মামলার প্রতিটি চার্জেই আসামিরা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য।

২. জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত অপরাধ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন (ভায়োলেশন অব সিরিয়াস হিউম্যান রাইটস) এবং নৃশংসতম অপরাধ (হেনিয়াস অফেন্স) হিসেবে চিহ্নিত। তাই এসব অপরাধের ক্ষেত্রে একমাত্র উপযুক্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত।

৩. নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষের ওপর পরিচালিত আক্রমণ ছিল ব্যাপক ও সুপরিকল্পিত; এর স্কেল অব অ্যাটাক ছিল মারাত্মক। এমন পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি দেয়া আইনগতভাবে সঠিক হয়নি।

৪. অপরাধের প্রকৃতি ও ভয়াবহতা (গ্র্যাভিটি অব দ্য অফেন্স) অনুযায়ী বিদ্যমান আইনের অধীনে এ ধরনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত এ বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল যথাযথভাবে প্রতিফলিত করেনি।

৫. শাস্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেবল আসামির অধিকার বিবেচনা না করে, ভুক্তভোগীদের অধিকার এবং সমাজের ন্যায্য প্রত্যাশাও (সোসাইটির রিজনেবল এক্সপেক্টেশন) বিবেচনায় নেয়া উচিত ছিল। সমাজ এ ধরনের অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা রোধ করা যায়।

৬. আসামিরা জানতেন যে তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মামলা চলছে এবং রায় ঘোষণা হয়েছে, আপিলের মেয়াদও ৩০ দিন সবকিছু জেনেও তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পলাতক থেকে গেছেন এবং বাইরে থেকে বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের আচরণের প্রেক্ষিতে তাদের শাস্তি কমানোর কোনো সুযোগ নেই।

৭. আসামিদের সরাসরি আদেশ ও নির্দেশনায় সারা দেশে চালানো পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে ১৪০০ এর অধিক মানুষ শহীদ এবং ২৫ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। এমন নৃশংস ফলাফলের পরও আমৃত্যুদণ্ড যথেষ্ট নয়।

৮. মামলার চার্জ-১ এ জুলাই অভ্যুত্থানের অগ্রদূত আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতি, পরিকল্পনা ও প্রতীকী গুরুত্ব বিচার করলে চার্জ-১ এও তাদের একমাত্র প্রাপ্য শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

প্রসিকিউটর তামিম বলেন, ‘এই অপরাধের নৃশংসতার গভীরতার তুলনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড অপরিপক্ব বা কম হয়েছে। আইন, প্রমাণ এবং নৈতিকতার সব মানদণ্ডে বিচার করলে এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডই ছিল ন্যায়বিচারের উপযুক্ত প্রতিফলন। তাই আমরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এ রায় সংশোধনের আবেদন করেছি।’



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews