ডিএমপির কাঁধে পাঁচ লাখ আলামতের বোঝা

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ক্রাইম, গোয়েন্দা ও ট্রাফিক বিভাগ প্রতিদিন বিভিন্ন মামলা ও জিডিতে অভিযুক্তসহ আলামত জব্দ করছে। এসব মামলার বিচারকার্য শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অধিকাংশ আলামত পড়ে রয়েছে পুলিশের ডাম্পিংয়ে। এতে পুলিশ স্টেশনগুলোতে জমেছে আলামতের স্তূপ।

ডিএমপির মালখানায় বর্তমানে পাঁচ লাখের বেশি আলামত পড়ে রয়েছে। এসব আলামত সংরক্ষণের জায়গা নেই পুলিশের। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছে তারা।

পুলিশ বলছে, কোনো মামলায় আসামিসহ আলামত জব্দ করার পর তালিকা করা হয়। সে তালিকা আদালতে জমা দেওয়ার পর এসব আর পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মামলার বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ আলামতের নিরাপত্তা দেয়। তবে ডিএমপির একাধিক ওসির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলামতের জব্দ তালিকা আদালতে জমা দেওয়ার পর আদালতের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করা যায় না। তবে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর আদালত আর আলামত নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নেয় না। এতে পুলিশের ওপর আলামতের বোঝা বাড়তেই থাকে। 

এদিকে দীর্ঘ দিন অযত্নে পড়ে থেকে অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আলামতের জিনিস নিতে অনাগ্রহ দেখায় মালিকরা। পুলিশ বলছে, থানায় বাহিনীর সদস্যদেরই থাকার জায়গা হয় না; সেখানে তারা আলামত রাখবে কোথায়? 

এদিকে থানার সামনে সড়ক দখল করে অনেক সময় আলামতের গাড়ি রাখা হয়।  এসব গাড়ি সরিয়ে নিতে সিটি করপোরেশন থেকে প্রায়ই থানাগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়। তবে পুলিশের করার কিছু থাকে না।
সম্প্রতি হাইকোর্ট আদালতের মালখানায় পড়ে থাকা আলামতের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়েছেন। এ মালখানার রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে পুলিশ। এ বিষয়ে একটি পত্রে ডিএমপি হাইকোর্টকে জানিয়েছে, অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের মালখানায় দীর্ঘদিন মামলার আলামত নিষ্পত্তির বিষয়টি একেবারে বন্ধ রয়েছে। আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হলেও আদেশনামা মালখানায় না পৌঁছানোয় এ জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাই মামলা নিষ্পত্তি হলেও আলামতের সংখ্যা বাড়ছে। 

এ পত্রে জানানো হয়, ডিএমপির মালখানায় ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অস্ত্র, গুলিসহ গাড়ি ও অন্যান্য আলামত সংরক্ষিত রয়েছে। ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার কিছু আদেশনামা পুলিশের মালখানায় পৌঁছালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসে না। এ ছাড়া ২০১০ সালের আগের কোনো আলামত নিষ্পত্তি বিষয়ে আদালত থেকে আদেশনামা পাওয়া যায়নি। এতে আলামত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে  দুই লাখ ৬০ হাজার মামলা ও জিডির বিপরীতে পুলিশের মালখানায় পাঁচ লাখের বেশি আলামত পড়ে আছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশ শাহবাগ, উত্তরা দিয়াবাড়ী, বছিলা, কাঁচপুর, মিরপুর পুলিশ লাইন্সে আলামত সংরক্ষণ করে। এ ছাড়া মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কিছু গাড়ি মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচেও রাখা হয়েছিল। পরে সেখানকার ৩০০ গাড়ির মধ্যে ১৭৫টি নিলামে বিক্রি করা হয়। বাকি ১২৫টি দিয়াবাড়ীতে রাখা হয়েছে। দেড় বছর ধরে শাহবাগ ডাম্পিংয়ে গাড়ি রাখে ডিবি। এর আগে দিয়াবাড়ী ডাম্পিংয়ে ৬০০ গাড়ি রেখেছে ইউনিটটি। 

বর্তমানে শাহবাগ ডাম্পিংয়ে ডিবি, সিটিটিসিসহ রমনা ও লালবাগ ট্রাফিক বিভাগ গাড়ি রাখে। ডিবির মালখানার হিোব বলছে, শাহবাগ ডাম্পিংয়ে তাদের ১০ বিভাগের ৩৩৩টি মামলা ও জিডির ৩৯০টি গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেলেও আলামত বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি আদালত।

সম্প্রতি শাহবাগ ডাম্পিংয়ে সরেজমিন দেখা যায়, রিকশা ও স্পিডবোট থেকে শুরু করে বাস, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে মামলার এসব গুরুত্বপূর্ণ আলামত। সেখানে অনেক গাড়ির অংশবিশেষ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। আবার অনেক গাড়ির চাকা থেকে শুরু করে মূল্যবান জিনিসপত্র খুলে নিয়ে গেছে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা।

এখানে এসব আলামতের নিরাপত্তার জন্য ডিবির দু’জন ও আনসার সদস্য রয়েছেন। তারপরও কীভাবে যন্ত্রাংশ খোয়া গেছে, তার উত্তর নেই কারও কাছে। এদিকে জায়গা সংকটের কারণে একটির ওপর আরেকটি রেখে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া গুলশান, বনানী, রমনা, মোহাম্মদপুর, আদাবর, পল্টন ও মতিঝিল থানার সামনে গিয়ে দেখা যায় জব্দ গাড়ির স্তূপ।

গত ৫ মার্চ শাহবাগ ডাম্পিংয়ে অগ্নিকাণ্ডে বেশ কয়েকটি গাড়ি পুড়ে যায়। এর মধ্যে একটি কাভার্ডভ্যানও ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাভার্ডভ্যানের মামলা ২০১৬ সালে নিষ্পত্তি হয়। তবে আদালত থেকে আদেশনামা না আসায় সেখানেই পড়ে রয়েছে। এদিকে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরও অনেক সময় গাড়ির মালিকপক্ষ থেকেও পুলিশের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। 

পুলিশ জানায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে শাহবাগ ডাম্পিংয়ে ডিবির ১০টি বিভাগের ৭০০ গাড়ি রয়েছে। পুলিশ নিজ উদ্যোগে আলামত নিষ্পত্তির জন্য গাড়ির মালিকানা যাচাই করতে গেলে বিআরটিএর পরিদর্শককে গাড়িপ্রতি ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া মালখানার অফিসাররা আদালতে যোগাযোগ করেও নিষ্পত্তির আদেশ পান না। এতে আলামত নিষ্পত্তি কঠিন হয়ে পড়েছে।
পুলিশের ডাম্পিংয়ে পড়ে থাকা কয়েক গাড়িমালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমকাল। এর মধ্যে একজন আপেল মাহমুদ। তিনি বলেন, ২০২১ সালে ডিবি পুলিশ আটক করে তাঁর মিনি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ন ১৩-১৯২৬)। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত সেখানেই পড়ে রয়েছে গাড়িটি। গত তিন বছর খোলা জায়গায় অরক্ষিত থাকায় মরিচা পড়ে গেছে। গাড়ি আটক করার পর অনেকবার শাহবাগে গিয়ে গাড়ি দেখে এসেছেন। কিন্তু গাড়ির আগের মালিকের অসহযোগিতার কারণে ট্রাকটি আর বের করতে পারেননি। মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি।

শাহবাগ ডাম্পিংয়ে পড়ে থাকা গাড়িমালিক সৈয়দ মোসাব্বির হোসেন, সাবিকুল হোসেন ও অমিত রাজবংশী জানান, মামলার তদন্ত ও বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতার কারণে জব্দ গাড়ি আর ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। পুলিশের হেফাজত থেকে বের করে আবার চালানোর উপযোগী করে রাস্তায় নামাতে যে টাকা খরচ হবে, তাতে আরেকটা নতুন গাড়ি কেনা যাবে। এ জন্য ওই গাড়ি আর বের করবেন না।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘আলামতের বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। যাতে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর আলামত ডাম্পিংয়ে পড়ে না থাকে সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের মালখানার সব আলামত ডেটাবেজের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews