প্রশ্ন ওঠে, রাজনীতি কি আদৌ একটি পেশা হতে পারে? প্রশ্নটি সঙ্গত। কারণ, যখন আমরা রাজনীতি শব্দটির সাথে পরিচিত হই, তখন মনে হয়, এটি শুধু জনগণের সেবা, আত্মত্যাগ এবং দেশপ্রেমের বিষয়। কিন্তু দিন দিন রাজনীতি একটি পেশা হিসেবে রূপ নিতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তন কীভাবে ঘটছে এবং এর প্রভাব কী হতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করা জরুরি।

প্রাচীনকালে রাজনীতি ছিল একটি ব্রত, একটি মহৎ উদ্দেশ্য, যেখানে জনগণের সেবা এবং দেশপ্রেম ছিল প্রধান লক্ষ্য। তখনকার রাজনীতিবিদরা নিজেকে দেশের কল্যাণে উৎসর্গ করতেন এবং তাদের জীবনে কোনো ব্যক্তিগত লাভের আশা ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের সেবা, দেশের উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাজনীতির সংজ্ঞা বদলে গেছে।

অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো রাজনীতির সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকেও অধিকাংশ রাজনীতিবিদের কোনো নির্দিষ্ট পেশা ছিল না। তারা শুধুমাত্র রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের সেবা করার অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। আজকাল দেখা যায়, রাজনীতির সাথে অনেক নেতাই ব্যবসা বা অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে আছেন। তারা ভোটের রাজনীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত আর্থিক লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি করছেন, যা রাজনীতি ও পেশার মধ্যে সীমারেখা একেবারে মুছে দিয়েছে।

বিখ্যাত জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে এক বক্তৃতায় রাজনীতির অর্থে নতুন এক দৃষ্টিকোণ উপস্থাপন করেন। ওয়েবার বলেন, ‘রাজনীতি একটি পেশা’। তার মতে, রাজনীতিবিদরা শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য বা জনপ্রিয়তার জন্য রাজনীতি করেন না। তাদের নৈতিক মেরুদ- থাকা উচিত এবং তাদের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। ওয়েবারের দৃষ্টিকোণ থেকে, রাজনীতির উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ এবং সমাজের উন্নতি হওয়া উচিত, নয়তো তা হবে কেবল ক্ষমতার লোভ। এছাড়াও, ওয়েবার বলেন, একজন রাজনীতিবিদ শুধুমাত্র ভোট পাওয়ার জন্য অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন না। তাদের কার্যক্রমের উদ্দেশ্য থাকা উচিত এবং তারা যখন ইতিহাসের পরিবর্তনের দিকে এগোবেন, তখন তাদের থাকতে হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব এবং বিচার করার ক্ষমতা। কিন্তু আজকের রাজনীতিতে অনেকেই শুধুমাত্র জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেন, যা বেশিরভাগ সময় বাস্তবে রূপ নেয় না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে রাজনীতিতে পেশাদারিত্বের পরিবর্তন হতে শুরু করে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৩১ শতাংশ ছিলেন আইনজীবী, ১৮ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী এবং কৃষক পরিবারের সদস্য ছিলেন ১১ শতাংশ। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই সংখ্যা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে ৩১ শতাংশ আইনজীবী কমে ১০ শতাংশে দাঁড়ায় এবং ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬১ শতাংশ হয়।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, রাজনীতি এখন শুধুমাত্র ক্ষমতা অর্জনের একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক নেতা এখন ব্যবসা বা অন্যান্য পেশা নিয়েই রাজনীতি করছেন, যার ফলে রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য দেশ ও জনগণের সেবা থেকে সরে গিয়ে তা ব্যক্তিগত লাভের দিকে চলে গেছে।

এখনকার রাজনীতির চিত্র আরও জটিল। পেশাগতভাবে যারা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ব্যবসায়ী। তারা এর মাধ্যমে যে অর্থ উপার্জন করেন, সেটি রাজনীতির জন্যও কাজে লাগান। এই পরিস্থিতি একটি কঠিন বাস্তবতা তৈরি করছে। ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার অভাব বাড়ছে। নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যারা রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের সেবা করতে চান, তাদের জন্য এই চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। এখনকার রাজনীতিতে যদি পেশা এবং উপার্জনকে আলাদা করা না যায়, তবে একদিন হয়তো রাজনৈতিক দলের নেতারা শুধুমাত্র টিকিট পাওয়ার জন্যই রাজনীতিতে প্রবেশ করবেন এবং জনগণের সেবা বা উন্নতি হবে না। এই পরিস্থিতি সমাজের জন্য উদ্বেগজনক।

রাজনীতি যদি পেশা হয়ে যায়, তবে তার সঙ্গে সম্পর্কিত দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্বও পাল্টে যাবে। যারা রাজনীতি করবেন, তাদের কাছে জনগণের সেবা নৈতিক দায়িত্বের চেয়ে ব্যবসায়িক চুক্তির মতো হয়ে দাঁড়াবে। এটি দেশের রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, যদি নতুন প্রজন্মের নেতারা বৈধভাবে উপার্জন করে এবং তাদের উদ্দেশ্য থাকে জনগণের সেবা, তবে সেই রাজনীতি সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে।

লেখক: কেন্দ্রীয় সংগঠক, জাতীয় নাগরিক কমিটি
[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews