নানা ধর্ম, দল মতে বিভক্ত এই পৃথিবীতে পশ্চিমা দেশগুলোয় বর্তমান মুসলিমবিদ্বেষ, গণহত্যা, বর্ণবাদী মনোভাব যেমন সত্য, তেমনি সত্য অ্যান্টিসেমিটিজম বা ইহুদিবিদ্বেষও। মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন সংকট থেকে শুরু করে ইরান, লেবানন, সিরিয়া, ইরাকসহ মুসলিম বিশ্বের একটি বৃহৎ অংশের আপামর জনগণের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ মনোভাব এতই প্রবল যে, বিশেষ এই আব্রাহামিক ধর্মটি নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণকে তারা খুব ভালোভাবে নেন না। এর প্রধান এবং একমাত্র কারণ প্রবল কর্তৃত্ববাদী এবং সদা নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বিতর্কিত দেশ ইসরায়েল। অথচ কট্টর জায়নবাদী ইসরায়েলের বাইরেও যে উদারপন্থি জুডাইজমিক এক ইহুদি বিশ্বাসের স্রোত বহমান তা হয়তো অ্যান্টি সেমিটিজমে আক্রান্ত অনেকে মাথাতেই নেন না। ফিলিস্তিন এবং বিভিন্ন আরব দেশে ইসরায়েলের আগ্রাসন, গণহত্যাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বলা যায় এখন অ্যান্টি সেমিটিজমের চর্চা তুঙ্গে। এমনকি অতীতের অনেকটাই উদার মুসলিম সামাজিক কাঠামোর এই দেশেও যে অল্প হলেও ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি ইতিহাস রয়েছে, সেটিও গলার জোরে অনেকে অস্বীকার করতে চান। এমন এক সময়ে এসে গবেষক ও সাংবাদিক আপেল মাহমুদের লেখা ‘বাংলায় ইহুদি সম্প্রদায়’ সত্য অনুসন্ধানের জন্য জরুরি একটি বই।
বাংলাদেশই বইটিতে প্রাধ্যান্য পেয়েছে। পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গও এসেছে। ‘কলকাতায় ইহুদি: আর্কাইভ’, ‘ইহুদিস্মারকে রবীন্দ্র-সত্যজিৎ’, ‘প্রথম মিস ইন্ডিয়া ইহুদিকন্যা এস্টার’-এর মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে এতে। বোঝা যায়, বইটির জন্য আপেল মাহমুদ বেশ পরিশ্রমসাধ্য অনুসন্ধান ও পড়াশোনা করেছেন।
কিন্তু বইটি খানিকটা কলকাতা ও ঢাকাকেন্দ্রিক ইহুদি ইতিহাসের তথ্য বিবরণী হয়ে গেছে। দু’একটি অধ্যায়ে একবার-দু’বার চট্টগ্রামে ইহুদিদের বসবাস কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা আছে, তবে সেটা একেবারেই না থাকার মতো। ফলে ঢাকা কলকাতার বাইরে বড় শহরগুলোয় ইহুদিদের কর্মকাণ্ড, ব্যবসা, ধর্মচর্চা বিষয়ে আগ্রহ জাগলেও বইটি সে খোরাক সরবরাহ করতে পারে না। রাজশাহীতে বরেণ্য ইহুদি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মার্ডি কোহেনের পূর্বপুরুষ সেমেটিক গোত্রের ইহুদি ব্যবসায়ীদের আগমন, ইসহাক কোহেন, তাঁর ছেলে সাসয়ন রাহেমিম কোহেনের খানিকটা উল্লেখ আছে। এ ছাড়া মার্ডি বা রাজশাহীতে একসময় মোনা সাহেব নামে খ্যাতি পাওয়া লোকটির রাজশাহী প্রেম, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলো নিয়ে আলাদা অধ্যায় আছে। কিন্তু এর পরও তথ্যের অধিকাংশই যেন ঢাকা-কলকাতা শহরকেন্দ্রিক।
ইতিহাসপ্রিয় পাঠক হিসেবে মনে হয়, এখন সময় এসেছে আপেল মাহমুদদের মতো গবেষকদের বাংলায় ইহুদিদের ইতিহাস অনুসন্ধানে বড় শহরগুলোর বাইরেও চোখ দেওয়া। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, পূর্ব মেদিনীপুরের মতো উপকূলীয় শহরগুলোর দিকে।সময়সাধ্য অনুসন্ধানকার্য এক কৌতূহলোদ্দীপক নানা তথ্যের জন্য ‘বাংলায় ইহুদি সম্প্রদায়’ বইটি যেমন প্রশংসাযোগ্য, তেমনি লেখনী ও সম্পাদনাগত ত্রুটি নিয়ে পাঠক হিসেবে কিছু সমালোচনার জায়গাও আছে। বিভিন্ন অধ্যায়ে এমন কিছু শব্দ, বাক্য আছে; যা ইঙ্গিতবহ বোঝা যায়, কিন্তু লেখক তার অর্থ পরিষ্কার করেননি। কিছু কিছু জায়গায় বাক্য গঠন এবং বানানে অসংগতি দেখা যায়। আবার বইয়ে ‘পল্টনে ইহুদি ক্লাব’ অধ্যায়টি দু’বার রয়েছে। প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টিতে আবার তথ্য বা লেখা বেশি। দ্বিতীয় মুদ্রণ হিসেবে সব মিলে বলা যায়, চমৎকার বইটি সম্পাদনাগত আরেকটু মনোযোগ পেতেই পারত। v