দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত নানান চড়াই উৎরাই পার করছে দিনের পর দিন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে চিকিৎসা মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় সাধারণ মানুষের। আর তাই অনেকেই বিদেশে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হয়ে পড়ছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) তথ্যমতে, দেশের প্রায় ৪৯ শতাংশ মানুষই মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পায় না। সেই সঙ্গে স্থানীয় সেবায় প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক মান না থাকায় বিশেষ করে আস্থাহীনতার কারণে দেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তরাও খরচ করছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। যার পরিমাণ বছরে প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের চিকিৎসকদের অনেকেই অন্যান্য দেশের চিকিৎসকদের চাইতেও মেধাবী। এক্ষেত্রে রোগীদের আস্থা ফেরাতে না পারলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব হবে না।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) এক গবেষণা বলছে, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মাথাপিছু ব্যয় ১১০ মার্কিন ডলার, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ব্যয় হয় ৪০১ মার্কিন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ হাজার ১২৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ৩.৭৮ শতাংশ। শুধুমাত্র ২০১২ সালে বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ায় বাংলাদেশীদের ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বর্তমানে দেশে ৫ হাজার ৪৬১ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে, যার মধ্যে ১ হাজার ৮১০টি ঢাকা বিভাগে অবস্থিত। পাশাপাশি ৩৬টি স্পেশালাইজড হাসপাতালের মধ্যে ১৯টি ঢাকায় অবস্থিত হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত ঢাকার ওপর চাপ বাড়ছে।
বাস্তবেও মিলে এর নানান প্রমাণ। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার ষাঠোর্ধ্ব শাহানারা বেগম। একমাত্র মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। দুই ছেলে দেশে থাকলেও ঢাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। রাজধানীর বদ্ধ জীবন ভালো না লাগায় বেশিরভাগ সময় গ্রামের বাড়িতেই থাকেন তিনি। বেশি কিছুদিন ধরে বুকের ডান দিকে চিন চিন করে ব্যথা অনুভব করলে জানান প্রবাসী মেয়েকে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে মেয়ের তখন দিশেহারা অবস্থা। যোগাযোগ করেন দেশের পরিচিত এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে রোগী দেখেন তিনি। বিস্তারিত শুনে বললেন মাকে পাঠিয়ে দিন। এরপর থেকেই শুরু হয় বিপত্তি। প্রথম দেখাতেই শাহানারা বেগমের কার্ডিয়াক এমআরই করার পরামর্শ দেন তিনি। হাসপাতালের বিলিং কাউন্টার থেকে জানানো হয় পরীক্ষা ফি ২৭ হাজার ৩০০ টাকা। মায়ের সুস্বাস্থ্যের চিন্তায় দিন পার করা ছেলে-মেয়ের কাছে তখন টাকার হিসাব করার সময় নেই। ওই এমআরইসহ রক্ত, প্র¯্রাব, ডায়াবেটিসসহ আরও কয়েকটি পরীক্ষা মিলিয়ে ৪৮ হাজার ৩০০ টাকার শুধু পরীক্ষারই সুপারিশ করেন ওই চিকিৎসক। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এবার যখন চিকিৎসা দেওয়ার পালা তখন ১০ হাজার টাকার ওষুধ মাসপ্রতি ওষুধ হিসেব ৬ মাসের ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেন তিনি। ছয়মাসে শুধু ওষুধ কিনতে হবে ৬০ হাজার টাকার।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের খরচ মিলিয়ে যখন প্রায় লাখখানেক টাকা খরচ হয়ে গেছে ওই পরিবারের তখন বাঁধে আরেক বিপত্তি। অসুস্থ মায়ের অভিযোগ যে এমআরই মেশিনে তার পরীক্ষার জন্য প্রবেশ করানো হয়েছিল সেই মেশিনটা ভেতর থেকে বের হওয়ার পর থেকে তার শরীর জুড়ে ব্যথা। বয়োবৃদ্ধ ওই মহিলা জানান, কোনো চিকিৎসক তো দূরে থাক সামান্য একজন নার্সও ছিলেন না তাকে যন্ত্রের ভেতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করার জন্য। এমন অবস্থায় কিছুটা ক্ষোভ আর অনিশ্চয়তা থেকেই পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অসুস্থ শাহানারা বেগমের আর কোনো চিকিৎসা বাংলাদেশে করানো যাবে না।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে চিকিৎসার জন্য। সেই অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে পাসপোর্ট-ভিসাসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে ভারতের চেন্নাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয় শাহানারা বেগমকে। যেখানে বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজার টাকার শুধু পরীক্ষাই দিয়েছিলেন চিকিৎসক। সেখানে পুরো চিকিৎসায়ই ৪০ হাজারের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আর ৬ মাসের ওষুধ দেয় ওখানকার চিকিৎসকরা মাত্র ১০ হাজার টাকার। সঙ্গে তাদের মনোমুগ্ধকর ব্যবহারে মানসিকভাবেও চাঙ্গা শাহানারা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, এখানকার চিকিৎসকদের কথা শুনে তো আমি বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কান্নাকাটি করে প্রবাসী মেয়েকে দেশে এসে আমাকে শেষবারের মতো দেখে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু ওই দেশের চিকিৎসকরা চিকিৎসা তো দিয়েছেনই পাশাপাশি মনের মধ্যে যে সাহস তৈরি করে দিয়েছে তাতে করে আরও অনেক দিন দিব্যি সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারব।
প্রায় একই অভিজ্ঞতার কথা বলেন ৩২ বছর বয়সের ব্যাংককর্মী টুম্পা বিশ্বাস (ছদ্মনাম)। কিছুদিন আগেই গর্ভপাত হওয়া নওগাঁ শহরের বাসিন্দা টুম্পা পেটের ব্যথায় প্রথমে স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে যান। তিনি জানান, টুম্পার কিডনিতে ইনফেকশন রয়েছে। তাই এ ব্যথা। এন্টিবায়োটিকসহ নানা রকম ওষুধ দিয়ে এক মাস পরে আসার কথা বলেন। টানা সাতদিন ওষুধ খেয়েও ব্যথা না কমায় আবার যান ওই চিকিৎসকের কাছেই। এবার এন্টিবায়োটিকের পাওয়ার বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর আশ্বস্ত করা হয় রাতের মধ্যে ব্যথা কমে যাবে। কিন্তু আবারও এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও একফোঁটাও ব্যথা না কমায় স্বামীর সঙ্গে আসেন রাজধানীতে। একটি বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান দেখাতে।
প্রায় ২৫ হাজার টাকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওই চিকিৎসক জানান কিডনি নয় তার জন্মগত টিবি রয়েছে। আর তাই এ ব্যথা। তিনি পরামর্শ দেন একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞকে দেখাকে। অগত্যা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের কাছে যান তিনি। সেই চিকিৎসক আরও ১৪ হাজার টাকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানান, টিবি নয় বরং তার লিভার অনেক বড় হয়ে গেছে। আর তাই এ ব্যথা। একজন লিভার বিশেষজ্ঞকে দেখানোর পরামর্শও দেন তিনি। অনেক খুঁজে রাজধানীর বড় একজন লিভার বিশেষজ্ঞের সিরিয়াল পান এক সপ্তাহ পর। রাজধানীতে থাকা-খাওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসকের ফি’বাবদ এরমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে প্রায় ১ লাখ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা থাকে কপালে এই লিভার বিশেষজ্ঞকে দেখিয়েই ফিরে যাবেন।
কিন্তু একি বিপত্তি! লিভার বিশেষজ্ঞ এতদিনের পুরো চিকিৎসা পদ্ধতিকে ভুল বলে আখ্যায়িত করে আরও কয়েকটি পরীক্ষা শেষে জানালেন তার ওভারিতে কিছু জটিলতা রয়েছে। যার সমাধান দিতে পারে একমাত্র গাইনি চিকিৎসকই। অনেক হয়েছে! ধৈর্য্যরে পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জমানো সব অর্থও এতদিনে শেষ। ফিরে গেলেন নওগাঁয়। ব্যথা নিয়ে অফিস-সংসারও শুরু করেন। কিন্তু দিন দিন যখন ব্যথার তীব্রতা বাড়ে তখন সিদ্ধান্ত নেন ঋণ করে হলেও ভারতে যাবেন চিকিৎসা করাতে। পরিকল্পনা মোতাবেক ভারতের চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে গেলে মাত্র কয়েকটি পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানান, যে গর্ভপাত হয়েছিল তার ভ্রƒণটা এখনো জরায়ুতে। আর তাই এ তীব্র ব্যথা। ছোট একটি অস্ত্রোপচার করেই ভ্রƒণটা ফেলে দেওয়া হয়।
তারপর থেকে এখন পর্যন্ত দিব্যি সুস্থ আছেন জানিয়ে টুম্পা বলেন, ভারতে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অস্ত্রোপচারসহ সব মিলিয়ে আমার খরচ হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশের এতগুলো চিকিৎসক চিহ্নিতই করতে পারলেন না আমার কি সমস্যা। তাহলে বলেন, কেন আমার পরিবারের অন্য কেউ যদি অসুস্থ হয় তাকে বাংলাদেশে চিকিৎসা করাব?
এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসকদের আন্তরিকতার সঙ্গে রোগীদের সেবা এবং আস্থার জায়গাটা না ফেরাতে পারলে বিদেশমুখিতা বাড়বে ছাড়া কমবে না।
শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য খাতে বিদেশমুখিতা কমাতে দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি’ বিষয়ক এক সেমিনারেও রোগীদের বিদেশমুখিতা কিভাবে ঠেকানো যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও)-এর তথ্য মতে বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষই মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পায় না, সেই সঙ্গে স্থানীয় সেবায় প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক মান না থাকায় বিদেশে স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ার প্রবণতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ সময়, এ খাতের উন্নয়নে বিশেষ করে উন্নত অবকাঠামো ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, বাজেট সহায়তা বাড়ানো, আন্তর্জাতিক হাসপাতলগুলো চেইন কার্যক্রম বাংলাদেশে চালু করা, বিদেশী ডাক্তার ও নার্সদের বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজীকরণসহ স্বাস্থ্যখাতের সকল ধরনের লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়নের প্রক্রিয়াগত জটিলতা নিরসন এবং ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেসরকারিখাতে হাসপাতাল কার্যক্রম চালু উৎসাহিতকরণে কর অব্যাহতি সুবিধা প্রদানের ওপর জোরারোপ করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
রোগীদের বিদেশমুখিতা কমানোর বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক এ কে খান আজাদ বলেন, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা স্বল্পতা, চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থার স্বল্পতা, সর্বোপরি স্বস্তির অভাবেই অসংখ্য লোক দেশের বাইরে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে, এগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের মাধ্যমে রোগীদের বিদেশমুখিতা হ্রাস করা সম্ভব।
দেশে পরিচালিত ল্যবারেটরিগুলোর মান উন্নয়নের ওপরও তিনি জোরারোপ করেন। তিনি বলেন, যেহেতু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞান একটি সর্বদা পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া, এমন অবস্থায় বর্তমানে আমরা যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি আগামী ২৫ বছর পর এক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে, তাই সেরা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি গ্রহণ করার জন্য আমাদের একটি সঠিক পাঠ্যক্রম থাকা জরুরি। দেশে পরিচালিত ল্যাবরেটরিগুলোর মান উন্নয়ন, বাজেট সহায়তা বাড়ানোর মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের শক্তিশালীকরণের ওপরও তিনি জোরারোপ করেন।