সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ঘরে বাতি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আমিনুল। প্রথমে কুপির চারদিক ভালো করে পরিষ্কার করল। তারপর সলতের পোড়া অংশ ঘষে ফেলে দিল। কুপিতে তেল ভরে দিয়াশলাই কাঠি ঘষে আলো জ্বালানো হলো। রাত যত গভীর হয় আলো তত প্রয়োজনীয় বস্তু হয়ে ওঠে। আলো ছাড়া চলা যায় না। ঘরে-বাইরে কোথাও আলোর বিকল্প নেই। অজু কিংবা ইস্তেঞ্জা যেখানেই যাও সঙ্গে আলো নিয়ে যেতে হয়। এশার নামাজের পর তেমন কাজ থাকে না আমিনুলের। জায়নামাজেই বসে থাকে অনেকক্ষণ। আজও বসে বসে নানা বিষয় নিয়ে ভাবছে। হঠাৎ একটি চমৎকার চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল মনে। এত দরকারি আলো কিন্তু কখনো কখনো বেশ সর্বনাশা হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে যখন আলো ব্যবহারকারী অসাবধান থাকে। এই তো কয়েক দিন আগে পাশের গ্রামের মোল্লাবাড়িতে আগুন লেগে সব ছাই হয়ে যায়। আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বাড়ির রমণীদের শাড়ির আঁচল থেকে। মানুষও মারা গেল। বাড়িও ছাই হয়ে গেল। আলো ব্যাপারটা যত সহজ মনে হচ্ছে আসলে এত সহজ নয়। একটু ভুল হলেই সব শেষ। চিন্তার জানালা খুলে গেছে আমিনুলের। আগুন থেকে ভাবনা মোড় নিয়েছে এলেমের দিকে। জ্ঞানও তো আলো। জ্ঞান ছাড়া ধর্মের পথে এক পা-ও চলা যায় না। তার মানে জ্ঞানও কি আগুনের মতোই ভয়ংকর? একটু অসাবধান হলেই সব শেষ হয়ে যায়? বিষয়টা হুজুর কেবলাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। হুজুর কেবলার নাম দৌলা শাহ অলি (রহ.)। ভারতের পাঞ্জাবে তার বসবাস। মজার ব্যাপার হলো- দৌলা শাহর মুরিদ সংখ্যা একজনই- মো. আমিনুল ইসলাম। গভীর রাতে দৌলা শাহ ঘরে এলে আমিনুল বিষয়টা নিয়ে কথা পাড়ে। ‘বাজান! এলেম কি কখনো আলেমের শত্রু হতে পারে?’

দৌলা শাহর ভাবলেশহীন উত্তর, ‘অবশ্যই পারে। বরং সচরাচর এমনই হয়ে থাকে।’ আমিনুলের কাছে বিষয়টা এখনো পরিষ্কার নয়। সে আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ নিয়ে পীরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পীর বললেন, ‘দেখো! এলেম হলো আগুনের মতো। তুমি আগুন সম্পর্কে জানতে পারো। আগুন ধরাতেও পারো। কিন্তু আগুন কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা জানার জন্য তোমাকে এমন একজনের সোহবতে থাকা জরুরি, যিনি আগুন ব্যবহারের কায়দা-কানুন ভালো করে আয়ত্ত করেছে। ছোটবেলায় তোমার মা যখন তোমাকে কুপি নিয়ে আসতে বলতেন কিংবা কুপি ধরাতে বলতেন তিনি কিন্তু তোমাকে বারবার সাবধান করে দিতেন। এমনকি তুমি যখন কুপি নিয়ে পড়তে বসতে তখনো মা তোমাকে সাবধান থাকতে বলতেন। এ সাবধান বাণীর কারণেই আজ তুমি আগুন ব্যবহার করে পথ দেখছো। নয়তো কবেই আগুনের ভুল ব্যবহারে নিজেকে ও আশপাশের সবাইকে পুড়িয়ে শেষ করে ফেলতে!’

বিষয়টা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে এসেছে। চোখ বড় বড় করে আমিনুল বলল, ‘এ কারণেই বুঝি এলেম অর্জনের পরও একজন আল্লাহওয়ালার সোহবতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে এলেমের ব্যবহারিক চর্চা সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে হয়?’  মাথা দোলাতে দোলাতে দৌলা শাহ বললেন, ‘তুমি একদম ঠিক ধরেছো। এলেম অর্জন করার পর সেটা নিয়ে মাঠে নামার আগে কোথায় কীভাবে কতটুকু প্রয়োগ করতে হবে সে বিষয়ে ভালো করে অভিজ্ঞতা অর্জন করা চাই। এ কারণেই জগতের যত বড় বড় আলেম আছেন তারা সবাই শরিয়তের এলেম শেখার পর তরিকতের মাশায়েখদের সোহবতে থেকে নিজেকে যুগের যোগ্য করে তুলেছেন। আর যারা তরিকতের এলেমে পিছিয়ে পড়েছে তারাই আগুন দিয়ে পথ দেখার পরিবর্তে ঘর পুড়িয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।’

পরদিনের ঘটনা। আসর নামাজ শেষে পীর-মুরিদ গেছেন নদীর ওই পাড়ে। কাজ শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল। তখনকার দিনে সন্ধ্যার পর ঘাটে খেয়া জুটত না। মুরিদ তো মহা টেনশনে পড়ে গেল। পীর বললেন, ‘চিন্তা করো না। নদীতে আমার চাদর বিছিয়ে দিয়েছি। আল্লাহর দয়ায় এটা নৌকার কাজ করবে। তবে তোমার কাজ হলো চাদরে দাঁড়িয়ে পীরের নাম জিকির করতে থাকবে।’ যেমন বলা তেমন কাজ। মুরিদ দৌলা দৌলা জিকির করতে করতে অর্ধেক নদী পার হয়ে গেছে। এমন সময় শয়তান বলল, ‘বোকা মুরিদ! দেখ তোর পীর মাওলা মাওলা জিকির করছে, আর তুই দৌলা দৌলা করছিস। তুই তো স্পষ্ট শিরিকে ডুবে আছিস। তোরও মাওলাকে ডাকা উচিত।’ মুরিদের টনক নড়ল। আরে! আমার তো মাওলা মাওলা করা উচিত। যেইমাত্র দৌলা বাদ দিয়ে মাওলা জিকির শুরু করল, সঙ্গে সঙ্গে সে নদীতে পড়ে গেল। পীর তাকে কোনোরকম টেনে তুললেন। পাড়ে এসে সব ঘটনা পীরকে খুলে বলল মুরিদ। সব শুনে দৌলা শাহ বললেন, ‘গত রাতে এ বিষয়টি নিয়েই আমরা আলোচনা করছিলাম। যখন তুমি কিতাবের এলেমের অহংকারে কলবের এলেম থেকে দূরে সরে যাবে তখনই এলেম তোমার শত্রু হয়ে যাবে। যেভাবে পথ দেখানো আগুন সব পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। শয়তান তোমার কাছে এসেছে এলেমের অহংকারের পথ ধরে। তুমি দৌলা ছেড়ে মাওলা জিকির শুরু করেছে। এখানেই পথ হারিয়েছো তুমি। দৌলার সোহবতের নায়ে চড়েই তোমাকে মাওলার প্রেম সাগর পাড়ি দিতে হবে। আগে তুমি দৌলাকে ধারণ কর। তারপর তুমি মাওলাকে পাবে। কোরআনে এমনটিই বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আল্লাহ প্রাপ্তির জন্য উসিলা খোঁজ।’ (সুরা মায়েদাহ, আয়াত ৩৫।’

লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট, পীরসাহেব, আউলিয়ানগর



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews